
ছবি: জনকণ্ঠ
সমুদ্র, বন ও নদী—এই তিন প্রকৃতির মেলবন্ধনে ঘেরা বরগুনার তালতলী উপজেলা দিন দিন পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর জনপ্রিয় ডিসি পয়েন্ট, শুভসন্ধ্যা, আশার চর, শুটকি পল্লী ও টেংরাগিরি ইকো পার্কের মতো স্থানগুলোতে প্রতিদিনই দেখা মিলছে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পর্যটকের। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, পর্যটকদের থাকার জন্য নেই কোনো মানসম্মত আবাসিক হোটেল বা রিসোর্ট। নেই ভালো কোনো খাবারের হোটেল বা রেস্টুরেন্ট। ফলে হাজার হাজার পর্যটক প্রতিনিয়ত চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন।
তালতলীর পর্যটন মানচিত্রে উল্লেখযোগ্য স্থান নিঃসন্দেহে ডিসি পয়েন্ট একটি পরিচ্ছন্ন, প্রশস্ত সমুদ্রসৈকত, যেখানে একই সঙ্গে বন ও সাগরের দৃশ্য দেখার জন্য প্রতিদিন ভিড় করছেন হাজার হাজার পর্যটক। শুভসন্ধ্যা সমুদ্রসৈকত, যেখানে বঙ্গোপসাগর ও পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদীর মিলনস্থলে জেলেদের মাছ ধরা ও নৌকার দৃশ্য আরও বাড়িয়ে দেয় দর্শনীয়তা। অন্যদিকে, টেংরাগিরি ইকো পার্ক বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, যেখানে হরিণ, বানর, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্যে ভরপুর।
সচেতন মহল বলছেন, তালতলীর ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য একে বাংলাদেশ পর্যটনের অন্যতম রত্ন বানাতে পারে। তবে তার জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়ন, পরিবেশবান্ধব হোটেল, প্রশিক্ষিত গাইড, পর্যটন নিরাপত্তা ও তথ্যব্যবস্থা। এছাড়াও, পর্যটনের জন্য অনন্য সৌন্দর্যময় তালতলী আজও অবহেলার শিকার। পর্যটক বাড়লেও বাড়েনি প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। সরকার ও বেসরকারি খাতে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ না করলে সম্ভাবনাময় এই পর্যটন অঞ্চল অচিরেই হারিয়ে যেতে পারে মানুষের মন থেকে। তাই পর্যটন খাতকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি করতে চাইলে তালতলীর মতো সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোর দিকে প্রশাসনের জরুরি নজর দেওয়া প্রয়োজন।
ঢাকা থেকে পরিবার নিয়ে আসা পর্যটক মাইনুল ইসলাম বলেন, “ইন্টারনেটে বিভিন্ন ভিডিও দেখে জায়গাটা খুব ভালো লেগেছিল। তবে জায়গাটি বাস্তবে আরও অনেক সুন্দর। তবে এখানে এসে দেখি কোনো থাকার ব্যবস্থা নেই। রাতে থাকার জন্য স্থানীয় একটা বাড়িতে অনুমতি নিয়ে অবস্থান করতে হয়েছে। খাবারের ব্যবস্থা আরও খারাপ। রাস্তার পাশে দুই-একটা ছোট দোকানে যা পাওয়া যায়, তাই খেতে হয়। এছাড়াও নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই। এই সকল বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন যদি ব্যবস্থা নেয়, তাহলে এই জায়গাটা পর্যটকদের জন্য আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।”
রাজশাহী থেকে আসা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মরিয়ম আক্তার বলেন, “এমন নয়নাভিরাম পরিবেশ আর শান্ত সমুদ্রসৈকত বাংলাদেশের আর কোথাও নেই। কিন্তু পর্যটকদের জন্য ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা নেই। এতে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। ভবিষ্যতে হয়তো আর কেউ পরিবার নিয়ে আসতে চাইবে না।”
রংপুর থেকে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে আসা আরেক পর্যটক মনিরুজ্জামান মনি বলেন, “তালতলী একটা হিডেন ট্রেজার বলা যায়। কিন্তু এটাকে ঘিরে কোনো পরিকল্পিত উদ্যোগ নেই। পর্যটনের সব সৌন্দর্য আছে, কিন্তু অবকাঠামোগত সুবিধা একেবারে শূন্যের কোঠায়। দ্রুত প্রশাসনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার।”
স্থানীয় দোকানি আবদুল জলিল বলেন, “এই ডিসি পয়েন্টে প্রতিদিন হাজার পর্যটক আসে, কিন্তু হোটেল না থাকায় অনেকেই ফিরে যান। কেউ কেউ আমাদের বাসাতেই থাকার অনুমতি চান। সরকার যদি একটু নজর দিত, তাহলে এখানকার অর্থনীতি অনেক এগিয়ে যেত।”
এই এলাকার আরেক বাসিন্দা মিরাজ বলেন, “আমরা চাই এখানে রিসোর্ট হোক, ভালো হোটেল হোক। তাহলে আমাদের এলাকার লোকজনেরও উপার্জনের সুযোগ বাড়বে। কিন্তু আজও কেউ এগিয়ে আসছে না।” তিনি আরও বলেন, “এই স্থানটি সম্প্রতি জনপ্রিয় হওয়াতে এখানে প্রতিদিন এত মানুষ আসে, কিন্তু তাদের থাকার জায়গা নেই, সাগরে গোসল করে ড্রেস চেঞ্জ করার কোনো স্থান নেই। কেউ কেউ আমাদের বাসায় এসে থাকতে চায়। সরকার যদি হোটেল-রেস্টুরেন্ট করার সুযোগ দিত, তাহলে আমরাও লাভবান হতাম।”
একই মত পোষণ করে ঐ এলাকার বাসিন্দা মিজানুর বলেন, “আমরা চাই এখানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে রিসোর্ট, রেস্টহাউস গড়ে উঠুক। তাহলে পর্যটকদের কষ্ট যেমন কমবে, তেমনি আমাদের জীবিকাও উন্নত হবে।”
তালতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উম্মে সালমা বলেন, “তালতলী পর্যটনের জন্য সম্ভাবনাময় এলাকা। আমরা পর্যটনের উন্নয়নে কাজ করছি। তবে পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি এখনো। আমরা বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দিচ্ছি। এছাড়াও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করছি হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট স্থাপনের জন্য। ভবিষ্যতে তালতলী দেশের অন্যতম পর্যটন হাবে পরিণত হবে। পর্যটকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হবে।” তিনি আরো বলেন, আপাতত আগত পর্যটকদের জন্য কাপড় চেঞ্জ এবং বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মুমু ২