
ঢাকা থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলা। ঘনবসতিপূর্ণ ১৪টি ইউনিয়নের প্রায় ৫ লাখ মানুষের ভরসা—শ্রীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। অথচ সেই ‘ভরসা’ এখন যেন নিভু নিভু প্রদীপ। অপ্রতুল জনবল, নড়বড়ে সরঞ্জাম, আর ‘বাতিল’ হয়ে যাওয়া সরকারি অ্যাম্বুলেন্স—সব মিলিয়ে হাসপাতালের সেবা কার্যত অচল।
হাসপাতালের একমাত্র সরকারি অ্যাম্বুলেন্সটি তিন বছর ধরে বিকল অবস্থায় পড়ে আছে। জরুরি অবস্থায় রোগী আনা-নেওয়ার জন্য মানুষের সেবা নিতে হয় বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের। হাসপাতালের আঙিনায় পার্ক করা থাকে একাধিক প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স। কিন্তু সুবিধা নয়, সেগুলো যেন বিপদই বাড়িয়ে দিয়েছে। চালকেরা নানা অজুহাত দেখিয়ে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে দাবি করেন অতিরিক্ত ভাড়া। দরকষাকষি থেকে সৃষ্টি হয় তীব্র বাগ্বিতণ্ডা।
এ বিষয়ে উপজেলা মাসিক সমন্বয় সভায় একাধিকবার আলোচনা হলেও সমস্যার সমাধান মেলেনি। হাসপাতালের এক চিকিৎসক অকপটে স্বীকার করেছেন—“অ্যাম্বুলেন্সটি এখন কার্যত বাতিল। মেরামতেরও সম্ভাবনা নেই।”
শ্রীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. জসিম উদ্দিন বলেন, “নতুন অ্যাম্বুলেন্সের জন্য সরকারের এক উপদেষ্টার কাছে আবেদন করা হয়েছে। বরাদ্দ পেলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এখানে দেওয়া হবে।”
অ্যাম্বুলেন্স সংকটের পাশাপাশি হাসপাতালের সবচেয়ে বড় সমস্যা মানবসম্পদের অভাব। ১ম থেকে ৪র্থ শ্রেণির জন্য অনুমোদিত মোট ২৫৮টি পদের প্রায় অর্ধেক শূন্য পড়ে আছে। টিকেট ক্লার্ক, কার্ডিওগ্রাফার, কম্পাউন্ডার, ইমার্জেন্সি এটেন্ডেন্ট, ল্যাব এটেন্ডেন্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো খালি। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক সেবা ব্যাহত হচ্ছে।
সবচেয়ে করুণ অবস্থা চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নিয়োগে। ২৬টি অনুমোদিত পদের মধ্যে ২৩টি শূন্য। পরিচ্ছন্নতাকর্মীর অভাবেও দুর্ভোগ বাড়ছে। হাসপাতালের শৌচাগার, ওয়ার্ড, ল্যাবরুম পরিচ্ছন্ন রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। অনেক কাজ চালাতে হচ্ছে অস্থায়ী, চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের দিয়ে।
ডা. জসিম উদ্দিন বলেন, “ডাক্তার সংকট নেই। তবে চতুর্থ শ্রেণির শূন্য পদ সবচেয়ে বড় সমস্যা। ঠিক কতগুলো পদ শূন্য আছে, নথি দেখে সঠিক সংখ্যা বলা সম্ভব হবে।”
২০২৩ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তিনি দায়িত্ব নেন শ্রীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে। দায়িত্ব নেওয়ার পর সমস্যা সমাধানের আশ্বাস মিলেছে বারবার, কিন্তু দৃশ্যমান পরিবর্তন চোখে পড়েনি এখনো।
বিকল অ্যাম্বুলেন্স মেরামত বা নতুন সংযোজন, শূন্য পদে দ্রুত নিয়োগ, হাসপাতাল চত্বর ও ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থার উন্নয়ন—সবই সীমাবদ্ধ আছে সভা-আলোচনা আর প্রতিশ্রুতিতে।
এ অবস্থায় ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা বলছেন, রাজধানীর এত কাছে থেকেও এমন বেহাল দশা স্বাস্থ্যব্যবস্থার নীরব ব্যর্থতার দলিল। তাঁদের প্রত্যাশা খুবই সাধারণ—একটা কাজের অ্যাম্বুলেন্স, পর্যাপ্ত জনবল, আর ন্যূনতম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন স্বাস্থ্য সেবা।
একজন স্থানীয় প্রবীণের কণ্ঠে শোনা গেল দীর্ঘশ্বাস মেশানো আক্ষেপ “আমাদের হাসপাতাল যেন প্রদীপের শেষ আলোটুকু নিয়ে টিমটিম করে জ্বলছে। কিন্তু কেউ যেন তা দেখতে পায় না।”
রাজু