
দৈনিক জনকণ্ঠ
"এক কলসি পানি আইন্না দেই, আর হ্যারা আমারে পাঁচ টাহা দেয়... টাহা পাইলে খাই, না পাইলে খাই না।" ঠোঁটের কোণে একফালি মুচকি হাসি, কিন্তু চোখে ক্লান্তির ছায়া। এমনভাবেই নিজের জীবনের করুণ গল্প বলছিলেন ৫৬ বছর বয়সী জাফর। পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার আমখোলা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে আশ্রিতভাবে বসবাস করছেন তিনি।
শারীরিকভাবে দুর্বল, রোগাক্রান্ত, একাকী জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত এই মানুষটির নেই নিজের ঘর, জমি, স্ত্রী কিংবা সন্তানের স্নেহ। এক সময় দিনমজুরের কাজ করলেও বয়স বাড়লে হারিয়েছেন কর্মক্ষমতা। এখন তিনি শুধু দোকানে দোকানে কলস ভর্তি পানি সরবরাহ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
প্রতিদিন প্রায় ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার পথ পা হেঁটে উপজেলা শহর গলাচিপায় আসেন এবং দোকানে কলসি ভর্তি পানি সরবরাহ করেন। বিনিময়ে পান প্রতি কলস মাত্র ৫ টাকা। আয় হয় দৈনিক ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। যা দিয়েই কোনো মতে এক বেলা খাবার জোগাড় হয়। আয় না হলে সেদিন উপোসেই কাটে তার দিন।
জাফরের স্ত্রী প্রায় ২০ বছর আগে তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। নেই কোনো সন্তান। জাফর বলেন, "আমখলা হইতে গলাচিপা আইতে যে দোহান গুলা বাজে, হ্যাগো পানি লাগলে আমি কলসি ভরে পানি এনে দেই। এতে যা টাহা (টাকা) পাই, তাই দিয়া খাই।"
মানুষ যেখানে হাজারো টাকা উপার্জনের জন্য নানা রকম কৌশল অবলম্বন করে। সেখানে জাফরের মত মানুষ সামান্য রুটি-কলা কিনে খাওয়ার জন্য রোগাক্রান্ত, ভঙ্গুর শরীর নিয়ে কাঁধে বহন করছে কলসি ভরা পানি, ছুটে চলছে গ্রাম থেকে শহরে। জাফরের চোখে নেই কোনো স্বপ্ন, মুখে নেই কোনো অভিযোগ। বর্তমান বা ভবিষ্যৎ কোনোটাই ভাবেন না তিনি।
জাফরের আশ্রয়দাতা মজিবর মিয়া বলেন,"আগে সে দিনমজুরির কাজ করত, কিন্তু এখন শারীরিকভাবে খুব দুর্বল। দোকানে পানি টেনে দিয়ে কোনোমতে চলে তার জীবন। আমি যতটা পারি তাকে সহযোগিতা করি। তার জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, কোনো সরকারি সহায়তাও পায় না।"
আমখোলা ইউনিয়নের বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান (পান্না) জানান, জাফর আসলে পটুয়াখালী সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ বাদুরা গ্রামের মুজু প্যাদার ছেলে।
সেখানে তার একমাত্র সহচর একটি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ভাই রয়েছে। সে জরাজীর্ণ ঘরে বসবাস করে। পরিবারের অভাব অনটন দেখে প্রায় ২৭ বছর আগে জাফর আমখোলা একটি বাড়িতে আশ্রিত হিসেবে থাকা শুরু করে।
ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিতে একজন সহজ-সরল মানুষ গলাচিপা বাজারের ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, " জাফর প্রতিদিন দোকানে দোকানে পানি সরবরাহ করে। অনেক সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকে, চিকিৎসার টাকাও থাকে না।
সহজ-সরল মানুষ, কিছুটা মানসিক প্রতিবন্ধী বলেই অনেক কিছু বুঝে না। আমরা পানি এনে দেয়াড় বিনিময়ে কিছু টাকা দেই তাকে। দীর্ঘদিন ধরে সে এই কাজ করছে।"
স্থানীয় চা দোকানি সিদ্দিক মিয়া জানান, "সে পানি এনে দেয়, আমরা ৫ টাকা করে দেই। ভারী কাজ করতে পারে না, শুধু পানিই টানে। এই কাজ করে তিনি এলাকা জুড়ে পরিচিত। পানি লাগলে কেউ তাকে দেখলেই ডাক দেয়।"
স্থানীয়দের মতে, জাফর সহজ-সরল ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। একদম নিরীহ। কখনো কারো সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে জড়ান না। কিন্তু তার এই সরলতার কারণে নিজের অধিকারটুকু বুঝে নিতে পারেন না।
ইউপি সদস্য বলেন আমখোলা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. শাহআলম বলেন, "আমি জাফরকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। সে খুব ভালো মানুষ, সহজ সরল প্রকৃতির। কোনো সহায়তা পায় কি না আমি জানি না। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে জেনে দেখবো।"
স্থানীয়দের দাবি জাফরের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) না থাকায় তিনি বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, ভিজিএফ/ভিজিডি খাদ্য সহায়তা, চিকিৎসা সহায়তা কোনোটিই পান না। সরকারি সহায়তা পেতে হলে জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক। স্থানীয় চেয়ারম্যানের সুপারিশপত্র, ছবি ও জন্মসনদ থাকলে তা করা সম্ভব।
স্থানীয়দের দাবি, "সংশ্লিষ্ট প্রশাসন যেন দ্রুত জাফরের এনআইডি করে তার জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা নিশ্চিত করে।" জাফরের মতো অসহায়, একাকী মানুষ যেন মানবিক রাষ্ট্রের করুণা নয়, অধিকার হিসেবে সাহায্য পায় এটাই হোক মানবতা।
হ্যাপী