ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১০ অক্টোবর ২০২৪, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১

ঠিক হয়নি এলএনজি টার্মিনালও

বড়পুকুরিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ ঘাটতি বাড়ছে

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:৪৮, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বড়পুকুরিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ ঘাটতি বাড়ছে

বড়পুকুরিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ ঘাটতি বাড়ছে

দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক ৫২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। আগে প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিট বন্ধ থাকলেও সচল ছিল তৃতীয় ইউনিট। গত সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তৃতীয় ইউনিটটির উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যায়। এতে পুরোপুরি বন্ধ আছে কেন্দ্রটি।

এদিকে দুই মাস পার হয়ে গেলেও ঠিক হয়নি সামিটের এলএনজি টার্মিনালটি। এতে সরবরাহ না থাকায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে অনেক গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। কমেছে ভারত থেকে আসা বিদ্যুতের সরবরাহও। সব মিলিয়ে জাতীয় গ্রিডে প্রতিদিন ঘাটতি হচ্ছে অন্তত আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের। ফলে তীব্র গরমে লোডশেডিংয়ে নাকাল হয়ে উঠেছে জনজীবন।

বিশেষ করে পল্লী এলাকার মানুষদের পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, মঙ্গলবার ১ হাজার ৭১০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। গত সোমবার ১ হাজার ৮৭৪ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। গত রবিবারও দেশে গড়ে ১ হাজার ২৯১ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সর্বশেষ তথ্যমতে, মঙ্গলবার দেশের সর্বোচ্চ চাহিদা ১৬ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের বিপরীতে উৎপাদন হয় ১৪ হাজার ৫০০। সোমবার দেশের সর্বোচ্চ চাহিদা ১৬ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের বিপরীতে উৎপাদন হয় ১৪ হাজার ৬৮১। ১ হাজার ৫১৯ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে। 
ঢাকার দুই বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ডিপিডিসি ও ডেসকোর তথ্য বলছে, গত সোমবার ঢাকায় বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল ৪০০ মেগাওয়াট। পরিস্থিতি সামলাতে ডেসকোকে অঞ্চলভেদে ৩ থেকে ৪ বার লোডশেডিং করতে হয়। ডিপিডিসির এলাকায় দুই থেকে তিনবার লোডশেডিং হয়। এর অন্যতম কারণ বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ, এলএনজি টার্মিনাল চালু না হওয়া এবং আমদানি কমে যাওয়া উল্লেখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিডিবির এক কর্মকর্তা জানান, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৩ হাজার ৫৯৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ আছে।

জ্বালানি সংকটে দেশে ৬ হাজার ২৮৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে। বিদ্যুতে প্রতিদিন গড়ে ৮৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস দেওয়া হচ্ছে, যা এপ্রিলে ছিল ১৩৫ কোটি ঘনফুট। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় গ্যাসের সরবরাহ কমেছে। পেট্রোবাংলা প্রতিদিন সরবরাহ করছে ২৫৯ ঘনফুট গ্যাস। জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি কমেছে।

ত্রিপুরা থেকে ঘণ্টায় ১৬০ মেগাওয়াটের স্থানে ৬০ থেকে ৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের সরকারি বেসরকারি খাত থেকে ভেড়ামারা দিয়ে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসার কথা থাকলেও মিলছে ৮৮০ মেগাওয়াট। আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও ৪০০ মেগাওয়াট কম আসছে। এর মধ্যে তীব্র গরমে বেড়েছে চাহিদাও। সব মিলিয়ে বৃষ্টি আসার পর চাহিদা কমলেই আপাতত সংকট কাটবে বলেও জানান তিনি।
জানা যায়, বড় পুকুরিয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া ইউনিটটি দিয়ে প্রতিদিন ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতো, যা জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছিল। বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু বক্কর সিদ্দিক সাংবাদিকদের জানান, প্রতিটি ইউনিটের জন্য দুটি করে ইলেকট্রো হাইড্রোলিক অয়েল পাম্প থাকে। যা ওই ইউনিটের জ্বালানি হিসেবে তেল সরবরাহের মাধ্যমে উৎপাদন কার্যক্রম সচল রাখে।

কিন্তু ২০২২ সাল থেকেই তৃতীয় ইউনিটের দুটির মধ্যে একটি পাম্প নষ্ট হয়ে যায়। এরপর থেকে একটি পাম্প দিয়েই ঝুঁকি নিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছিল। কিন্তু ওই একটি পাম্পও সোমবার নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর দিনব্যাপী চেষ্টা করেও চালু করা সম্ভব হয়নি। ফলে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে উৎপাদন। আবু বক্কর সিদ্দিক আরও জানান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। তারা দুই সপ্তাহ সময় চেয়েছেন। চীন থেকে মেশিন এলেই উৎপাদন শুরু করা যাবে।

এদিকে গত ২৭ মে রেমালের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামিটের টার্মিনাল। এরপর এটি মেরামতের জন্য সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়। মেরামত শেষে দেশে ফেরার পর গ্যাস সরবরাহ চালুর আগেই আবার দুর্ঘটনায় পড়ে সামিটের টার্মিনাল। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল রেমালের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এটি থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ আছে আড়াই মাসের বেশি সময় ধরে। এটি চালু হতে আরও এক মাস লাগতে পারে বলেও জানা যায়। এর ফলে চলমান গ্যাস সংকটও শীঘ্রই কাটছে না।
এর আগে গত ১৫ আগস্ট এক বিজ্ঞপ্তিতে সামিট জানিয়েছে, সমুদ্রের অবস্থা ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে চলতি মাসের শেষ দিকে টার্মিনালের ডিটিএম প্লাগটি পুনর্স্থাপন ও পুনর্সংযোগ দিতে পারবে। এরপর আগামী মাসের মাঝামাঝি এলএনজি সরবরাহ শুরুর জন্য এটি তৈরি হবে। এদিকে সরবরাহ সংকটে সপ্তাহখানেক ধরে চলা লোডশেডিং তীব্র আকার ধারণ করেছে। ভোগান্তিতে রয়েছে সর্বস্তরের মানুষ। যদিও শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং হচ্ছে বেশি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোডশেডিং বেড়েছে। গ্যাস সংকট ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎও মিলছে না। তাই লোডশেডিং বেড়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে মানুষ। ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতি হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে সেচ কার্যক্রম। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বড় ধরনের ক্ষতির শঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
বিদ্যুৎ বিতরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দৈনিক প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিংয়ে নাকাল হয়ে পড়েছে জনজীবন। জনকণ্ঠের বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, গাইবান্ধার পাঁচ উপজেলার অনেক এলাকায় রাতে দুই-তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন গ্রাহকরা।

পৌর এলাকার গৃহিণী শিপ্রা জামান বলেন, লোডশেডিংয়ে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার অনেক ক্ষতি হচ্ছে। গরমের কারণে রাতে ঘুমাতেও পারি না। বিদ্যুৎ ঠিকমতো না পাওয়ায় ব্যবসা করতে পারছি না। নেসকো গাইবান্ধার নির্বাহী প্রকৌশলী ফজলুর রহমান জানান, চাহিদার তুলনায় তিনিও বিদ্যুৎ পাচ্ছেন কম। তাই ঘাটতি পূরণে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।
নেসকো সূত্রে জানা যায়, বগুড়ায় বিদ্যুতের চাহিদা ১০৫ মেগাওয়াট। আর জাতীয় গ্রিড থেকে মিলছে ৫০ থেকে ৬০ মেগাওয়াট। নীলফামারীতে লোডশেডিংয়ে ব্যাহত হচ্ছে শিল্পকারখানায় উৎপাদন। ছোট ছোট উদ্যোক্তারা পড়েছেন ক্ষতির মুখে। শুধু তাই নয়, লো-ভোল্টেজে ঝুঁকি নিয়ে মিল-কারখানা চালাতে গিয়ে বৈদ্যুতিক মোটর ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। বিদ্যুৎ থাকছে না সুনামগঞ্জেও।

জেলার দিরাই উপজেলার শ্যামানন্দ রায় জানান, সোমবার রাত ১০টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ ছিল না। পরে কিছুক্ষণ বিদ্যুৎ পেলেও রাত আড়াইটা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত আবার বিদ্যুৎহীন। হবিগঞ্জের শহরসহ বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দারা লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ। নগরীর পুরান মুন্সেফী এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, তীব্র গরমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে বাড়ির শিশুসহ সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এর থেকে মুক্তি চাই।
পল্লি এলাকায় দিনের তুলনায় রাতেই লোডশেডিং হচ্ছে বেশি। রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে ঘন ঘন বিদ্যুৎ যাওয়ায় গ্রাহকদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। উত্তরের ১৬ জেলায় পল্লী বিদ্যুৎ ও নেসকো মিলে বিদ্যুতের চাহিদা ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। কিন্তু দুইদিন ধরে সরবরাহ মিলছে ১ হাজার ৭০০  থেকে ১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। রংপুর বিভাগের আট জেলায় পল্লী বিদ্যুৎ ও নেসকো মিলে চাহিদা ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে ৮০০ মেগাওয়াটের কম বিদ্যুৎ।

রাজশাহী বিভাগে ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সরবরাহ কম থাকায় ঘন ঘন লোডশেডিং দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। লোডশেডিংয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন রাজধানীবাসীও। গতকাল দুপুর পর্যন্ত দুইবার বিদ্যুৎ যায়। একবার এক ঘণ্টা আরেকবার দেড় ঘণ্টার বেশি সময় বিদ্যুৎ ছিল না। মিরপুরের বাসিন্দা নুসরাত জাহান বলেন, একটু পর পর লোডশেডিং না দিয়ে একবার দিলে ভালো হয়।

×