ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১

প্রাকৃতিক সেচ প্রকল্পে সারা বছর মিলবে পানি

জাহিদ হাসান মাহমুদ মিম্পা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ

প্রকাশিত: ২০:৫৫, ৪ আগস্ট ২০২৪

প্রাকৃতিক সেচ প্রকল্পে সারা বছর মিলবে পানি

.

চাঁপাইয়ে স্বপ্ন বুনছেন কৃষক

ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে ফসল উপাদন করা বরেন্দ্র এলাকায় পানির স্তর অনেক নিচে নামছেএ থেকে উত্তরণে নেওয়া হয়েছে নতুন উদ্যোগনদী ও বিভিন্ন জলাধার থেকে পানি ব্যবহার করে ফসল উপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাঁচটি উপজেলায় সারাবছর জমিতে নিরবচ্ছিন্ন সেচ দিতে ১৭০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে

এতদিন ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করেই ফসল উপাদন করা হচ্ছিল বরেন্দ্র এলাকায়কিন্তু সেই পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছেএ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে নদী ও বিভিন্ন জলাধার থেকে পানি ব্যবহার করে ফসল উপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছেগভীর ও প্রশস্ত করে খনন করা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে কোনো কাজে না আসা মরা খালগুলোসেখান থেকে ৯৮টি সোলার প্যানেলের মাধ্যমে ৯৮টি সেচপাম্প দিয়ে কৃষকের জমি পর্যন্ত সেচের পানি যাবেখালে পানি আসবে নদীতে থাকা ভাসমান পাম্প স্টেশনের মাধ্যমেএ প্রক্রিয়ায় জমিতে সেচ সুবিধা নিশ্চিত করতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাঁচটি উপজেলায় বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য বরেন্দ্র এলাকার খালে পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্পনামে এ প্রকল্প হাতে নিয়েছে বিএমডিএকৃষকরা জানান, এ প্রকল্প বাস্তবায়নে এক ফসলি জমিতে পানি মিলবে বছরজুড়েপাশাপাশি সেচ সুবিধা পাবে অনাবাদি জমিবরেন্দ্র এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে ভূ-উপরিস্থ পানি কম থাকেঅন্যদিকে, বর্ষাকালে এ এলাকার নদীগুলোয় পানি থাকেপ্রকল্পের আওতায় নদীর পানি সংরক্ষণ করে শুষ্ক মৌসুমে সেচ কাজে ব্যবহার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছেপানি সরবরাহের জন্য উস হিসেবে ধরা হয়েছে মহানন্দা ও পুনর্ভবা নদীকেএসব নদী থেকে পানি এনে জলাধারে পানি সংরক্ষণের জন্য ৩৮ কিলোমিটার খাল এবং একটি পুকুর ও দুটি বিল পুনর্খনন করা হচ্ছেজানা যায়, পানি আনা ও জমিতে সরবরাহের লক্ষ্যে ১৪৮ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে

কৃষকরা জানান, বরেন্দ্র এলাকায় এ প্রকল্প তাদের জন্য আশীর্বাদপ্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এক ফসলি জমিতে বছরজুড়ে চাষাবাদ হবেএতে খরচ কমার পাশাপাশি বাড়বে ফসল উপাদনএর পাশাপাশি কমবে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারপ্রকল্পের আওতায় মহানন্দা নদী থেকে পন্টুনের মাধ্যমে পানি উঠিয়ে বরেন্দ্র এলাকার শুকিয়ে থাকা খালগুলোতে সারা বছর সংরক্ষণ করা হবেখাল থেকে সৌরবিদ্যুতের সাহায্যে ছোট ছোট পাম্পের মাধ্যমে পানি তুলে জমিতে সেচ দিতে পারবেন কৃষকরাসে ক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থাও করে দেবে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষগোমস্তাপুর উপজেলায় পুনর্ভবা নদীর সোনাতলা পাবদামারি খাড়ি তিন কিলোমিটার খনন এবং কোচল বিল ও চূড়ল বিল এলাকার সোনাতলা স্থানে একটি পন্টুন স্থাপন করে ২২টি সোলার এলএলপির মাধ্যমে ২০ কিউসেক পানি সরবরাহ করা হবেচাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার গণির মোড় ও গোবরাতলা এলাকায় মহানন্দা নদী থেকে ৪০ কিউসেক পানি উত্তোলন এবং সাত কিলোমিটার খাল পুনর্খনন করা হবেএছাড়া নাচোল উপজেলায় পুনর্ভবা নদীর কাজিগ্রাম ও বিজলিপাড়া দিঘি কোচড়া এলাকায় ৬.৫০ কিলোমিটার খাল খনন ও আশপাশের এলাকায় একটি পন্টুন স্থাপন করে ১৬টি সোলার পাম্পের মাধ্যমে ২০ কিউসেক পানি সরবরাহ করা হবে

শিবগঞ্জ উপজেলার ধাইনগর ইউনিয়নের শ্মশানঘাট এলাকার কৃষক শফিকুল ইসলাম বলেন, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ পানির জন্য এখন হাহাকার করেফসল চাষাবাদ করতে পারি না পানির অভাবেএক বিঘা জমিতে পানি দিতে খরচ হয় দুহাজার টাকাতবে আমাদের এলাকায় বিএমডিএর এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে খরচ অনেক কমে আসবেসেক্ষেত্রে কৃষকদের এক বিঘা জমিতে চাষাবাদে ৬০০-৭০০ টাকা খরচ হবেএতে লাভবান হবে কৃষকরা

একই উপজেলার মর্দনা গ্রামের আমচাষি জিয়ারুল ইসলাম বলেন, আমার ১৫ বিঘা জমিতে আমের বাগান রয়েছেআমে গুটি আসার পর থেকে অনেক স্প্রে ও সেচের পানি লাগেকিন্তু ভূগর্ভস্থ পানির সংকটের কারণে এ বছর বাগানে পানি দিতে পারিনিফলে আমের গুটি ঝরে পড়েছে ব্যাপকহারেপ্রচুর পরিমাণে ফলন বিপর্যয় ঘটেছে আমার ও আশপাশের কয়েক হাজার বিঘা আম বাগানেচলতি বছর সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ ফলন কম হয়েছে পানি সংকটের কারণে

গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ হানিফ বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের এসব উঁচু জমিতে পানির অভাবে একটি ফসল হয়বাকি অন্য সময়ে অনাবাদি পড়ে থাকে জমিগুলোকিন্তু বিএমডিএর এই প্রকল্পের সুবাদে উঁচু এসব জমিতে পানি পাওয়া যাবে বছরজুড়েফলে সেসব জমিও এখন চাষাবাদের আওতায় আসবেএ প্রকল্পকে ঘিরে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা

ষাটোর্ধ্ব মকবুল হোসেন বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারে জমির উর্বরতা নষ্ট হয়কারণ মাটির নিচের তোলা পানিতে প্রচুর পরিমাণে লবণাক্ততা থাকেকিন্তু এ প্রকল্পের আওতায় খালগুলো খনন করে নদী থেকে আনা পানি ব্যবহার করা হবেপাশাপাশি বৃষ্টির পানি আটকে তা ব্যবহার করা হবে জমিতেফলে এসব পানির ব্যবহারে জমির উর্বরতা নষ্ট হবে নাএমনকি পানির স্তরও নিচে নামবে নাএ বিষয়ে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চাঁপাইনবাবগঞ্জ রিজিওনের নির্বাহী প্রকৌশলী আল মামুনুর রশীদ বলেন, এক ইঞ্চি মাটিও যেন পতিত পড়ে না থাকে, সারাবছর যেন কৃষক তাদের কাক্সিক্ষত ফসল উপাদন করতে পারেন, সে লক্ষ্যেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছেএতে বরেন্দ্র অঞ্চল ও এর আশপাশের জমিতে কৃষকরা সারাবছর কম খরচে সেচ পাবেনএছাড়া যে জমিগুলোতে বছরে মাত্র একটি ফসল উপাদিত হতো, ওইসব জমিতে এখন তিনটি ফসল উপাদিত হবেসেচ কাজে নদীর পানি ব্যবহার করায় জমির উর্বরতাও বাড়বে দ্বিগুণতিনি আরও বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্তএরইমধ্যে শেষ হয়েছে প্রকল্পের ৪০ শতাংশ কাজপ্রকল্পের আওতায় ২২৯০ হেক্টর জমিতে ফসল উপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ হাজার ৩২০ মেট্রিক টন

×