চলছে সংস্কার। ধীরে ধীরে আপন চেহারায় ফিরছে পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক স্থাপনা লালকুঠি
এই কিছুদিন আগেও নর্থব্রুক হল বা লালকুঠি ছিল জীর্ণ এক ভবন। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন যখন তখন ভেঙে পড়তে পারেÑ এমন শঙ্কাও ছিল। বাইরে থেকে তাই তালা দেওয়া থাকত। ভেতরে অন্ধকার। সব মিলিয়ে ভুতুড়ে একটা পরিবেশ বিরাজ করছিল সেখানে। কিন্তু বর্তমানে নবরূপে সামনে এসেছে ঐতিহাসিক স্থাপনা। ‘নবরূপ’ বলতে পাল্টে যাওয়া কিছু নয়, বরং অবিকল গঠন নির্মিতি নিয়ে স্বরূপে উদ্ভাসিত হয়েছে। বাইরের কাঠামো এবং নির্মাণশৈলী যতটুকু স্পষ্ট হয়েছে তাতেই চোখ ফেরানো দায়।
ইতিহাসপ্রেমী মানুষ এমনকি সাধারণ দর্শনার্থীদের বিস্ময় দৃষ্টি এখন ভবনটির দিকে। কারণ আর কিছু নয়, ভবনটিতে সংস্কার কাজ চলছে। যেনতেন ভাবে চুনকাম করা নয়। ইতিহাসবিদদের পরামর্শে এ কাজে বিশেষজ্ঞ যারা তারাই কাজটি করছেন। উদ্যোগটি নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
বহুকাল আগের কথা। বুড়িগঙ্গায় যখন স্বচ্ছ জল ছিল, যখন ঢেউ খেলত অবিরত সেই সময় একেবারে তীর ঘেঁষে দৃষ্টিনন্দন এই ভবন নির্মাণ করা হয়। তখন ব্রিটিশ আমল। ইতিহাসবিদদের মতে, ১৮৭৪ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল জর্জ ব্যরিং নর্থব্রুক ঢাকা সফরে আসেন। তার সফর স্মরণীয় করে রাখার অংশ হিসেবে টাউন হল হিসেবে এটি নির্মাণ করা হয়। একই কারণে নামকরণ করা হয় তার নামে।
লালকুঠি আরও একটি বিশেষ কারণে বিখ্যাত। বাঙালির প্রাণের মানুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য এই ভবন। ১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কবিগুরুর পদচিহ্ন পড়ে এখানে। সে সময়কার ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি ও পিপলস অ্যাসোসিয়েশন বিশ্বকবিকে ভবনটিতে সংবর্ধনা প্রদান করে।
এর আগে-পরে বিভিন্ন সময়ে লালকুঠি নগর মিলনায়তন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বলে জানা যায়। এখানে ছিল বৃহৎ পাঠাগার। নাটকসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি আয়োজন করা হতো। এভাবে আদি ঢাকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠেছিল।
তবে সময় বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে চরম অবহেলার শিকার হতে থাকে বুড়িগঙ্গা তীরের স্থাপনা। দখলের চেষ্টাও কম হয়নি। আশার কথা যে, একই সময় ইতিহাস সচেতন মানুষেরা স্মৃতি রক্ষার জোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন। দায়িত্বশীলরা বিগত দিনে এই দাবি শুধু উপেক্ষাই করে গেছেন। অবশেষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নাগরিক দাবির প্রতি সমর্থন জানান।
বর্তমান নগর পিতা শেখ ফজলে নূর তাপস এ বিষয়ে ভীষণ আন্তরিক। জানা যায়, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরামর্শ আমলে নিয়ে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে কাজ করছেন তিনি। সিটি করপোরেশনের তথ্য মতে, বিচ্ছিন্নভাবে কিছু তারা করছেন না।
ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলোকে চিহ্নিত করে ‘সেভেন হেরিটেজ’ বলয় গড়তে চান। সে লক্ষ্যে একাধিক স্থাপনা সংস্কার শুরু হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে সংস্কার করা হচ্ছে লালকুঠি। সংস্কার কাজের মূল দায়িত্বে রয়েছেন অধ্যাপক ড. আবু সাঈদ। অনেক দিন ধরেই দিন রাত কাজ হচ্ছে সেখানে।
গত রবিবার লালকুঠির সংস্কার কাজ দেখতে গিয়ে রীতিমতো পুরো ভবন দেখার সুযোগ হয়ে গেল। বাইরে থেকে পুরো ভবনটিই অবিকল দৃশ্যমান। আগের সেই মুঘল স্থাপত্য রীতি, সেই সঙ্গে ইউরোপীয় রেনেসাঁর মিশেল। পুরনো ছবির সঙ্গে মিলিয়ে, বর্ণনার সঙ্গে হুবহু কি না তা পরীক্ষা করে সংস্কার করা হচ্ছে। মূল রাস্তা থেকে নামতেই চোখে পড়ে বিশাল গম্বুজ, সুউচ্চ চূড়া। ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, সেখানেও কাজ চলমান। দেওয়াল, ছাদ এবং মেঝেতে কাজ করা হচ্ছে।
অধ্যাপক ড. আবু সাঈদ জানান, নর্থব্রুক হল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা। এর আদি রূপ এবং ভবিষ্যৎ স্থায়িত্ব মাথায় রেখে কাজ করা হচ্ছে। এ কারণে সময় লাগছে। বহির্কাঠামো মোটামুটি পরিষ্কার হলেও ভেতরে আরও ডিটেইল কাজ করতে হবে। সব ঠিক থাকলে অচিরেই কাজ শেষ হবে। তখন সিটি করপোরেশন সবার জন্য লালকুঠি উন্মুক্ত করে দেবে বলে জানান তিনি।