ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

সকল বিভেদ ভুলে আপন পরিচয়ে বাঙালি

বর্ণিল উৎসবে বর্ষবরণ

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:০৭, ১৬ এপ্রিল ২০২৪

বর্ণিল উৎসবে বর্ষবরণ

ঢাকা বিশ্ববিাদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রা

পহেলা বৈশাখে আবারও চেতনায় শাণ দিল বাঙালি। শিকড়ের শক্তিতে জেগে উঠল নতুন করে। ধর্মীয় উগ্রবাদ, অসহিষ্ণুতা, ফতোয়াবাজির বিপরীতে উদার অসাম্প্রদায়িক লোক চেতনার বিপুল বিশাল জাগরণ দেখল দেশ। তিমির বিনাশের দৃঢ় শপথে বরণ করে নেওয়া হলো নতুন বছর-১৪৩১ বঙ্গাব্দকে। 
বর্ণিল উৎসবের পাশাপাশি বাঙালি এদিন দারুণ ঐক্যের বহির্প্রকাশ ঘটিয়েছে। হাত ধরাধরি করে এগিয়ে গেছে তারা। লোকায়ত জীবন, নিজস্ব কৃষ্টির কাছে ফিরেছে সগৌরবে। কৃতজ্ঞ চিত্তে পূর্ব পুরুষের সকল দান স্বীকার করে নিয়েছে। অন্যের আচার, ধার করা সংস্কৃতির চাকচিক্য কাউকে এদিন ভুলিয়ে রাখতে পারেনি। বরং আত্মপরিচয়ের সন্ধান করেছে সবাই।  
এবার বর্ষবরণের আগের কয়েকদিন ঈদের ছুটি ছিল। উদ্যাপনের দিন ছিল প্রখর রোদ। নিরাপত্তার নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়িও ছিল যথারীতি। কিন্তু উৎসব আনন্দে মাতোয়ারা বাঙালির কাছে কোনো বাধাই শেষতক বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। রাজধানীতে দীর্ঘ পথ হেঁটে রমনা বটমূলে সমবেত বটমূলে সমবেত হয়েছে সব বয়সী মানুষ। ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে কাক্সিক্ষত জন¯্রােত নেমেছিল। চারুকলা থেকে বের হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল সব সময়ের মতোই বর্ণিল। ঢাউস ঢাউস শিল্প কাঠামোর সঙ্গে অগণিত মানুষ মনের আনন্দে হেঁটে গেছে। সারাদেশেই ছিল অভিন্ন চিত্র। মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ বর্ণিল নানা আয়োজনে বিভাগ জেলা এমনকি উপজেলা পর্যায়ে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপিত হয়েছে। 
ঢাকায় সূর্য ওঠার বেশ আগেই ঘুম থেকে ওঠে পড়েছিল মানুষ। ঘরে ঘরে ছিল ঘর ছেড়ে বের হওয়ার তাড়া। ছোট বড় সবাই স্নান-গোসল সেরে বাঙালির সাজে পথে নেমে এসেছিল। ছিল না হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন। বৌদ্ধ না খ্রিস্টান জিজ্ঞেস করেনি কেউ। সবাই বাঙালি। এ পরিচয়েই একে অন্যের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। যেদিকে চোখ গেছে সেদিকেই লাল সাদা রং। তরুণীরা শাড়িতে সেজেছিলেন। তরুণরা পরেছিলেন পাঞ্জাবি।

মা-বাবার কোলে কাঁধে চড়ে এসেছিল শিশুরা। এভাবে সকলের অংশগ্রহণে গোটা শহর উৎসবমুখর হয়ে উঠেছিল। পরিবারের সদস্য আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব প্রেমিক প্রেমিকারা ঘুরে বেড়িয়েছেন। পায়ে পা লাগছিল। গায়ে গা। তবে কেউ কারও যন্ত্রণার কারণ হননি। বরং উৎসবের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল বাঙালি। এ সময় কারও হাতে ছিল লোক ঐতিহ্যের বাঁশি। কারও হাতে একতারা। অনেকেই ঢোল বাজিয়েছেন। নেচেছেন। গেয়েছেন। বিভিন্ন রাস্তায় আলপনা করা হয়েছে। আয়োজন করা হয়েছে বৈশাখীমেলাও। 
ছায়ানটের সঙ্গে শুরু ॥ বর্ষবরণ উৎসবের শুরুটা হয় ছায়ানটের সঙ্গেই। বহু বছরের ঐতিহ্য মেনে সূর্য ওঠার আগেই নগরবাসী সমবেত হতে শুরু করে রমনা বটমূলে। সোয়া ছয়টায় ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চ থেকে ভেসে আসে রাগালাপ আহীরভৈরব। এর পর কখনো সম্মেলক কণ্ঠে গান। কখনো একক কণ্ঠে। কখনো আবার আবৃত্তি। রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলের গান, লোকসংগীত- কী যে ভালো লাগছিল! এবারের গান নির্বাচন, পরিবেশনা, সাউন্ড সবই ছিল ভীষণ উপভোগ্য। অনেকগুলো গান বারবার শোনা।

বিপুলভাবে সমাধৃত। ফলে শ্রোতারাও সমানভাবে গেয়ে গেছেন। বিশেষ করে বলিউড সিনেমায় বিকৃতির শিকার ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানের প্রকৃত সুর, বিদ্রোহী কণ্ঠ ভীষণ উপভোগ্য হয়ে ওঠেছিল। একইভাবে দোলা দিয়ে গেছে ‘এই শিকল পরা ছল’ গানটি। নজরুলের গানে প্রতিবাদ প্রতিরোধ কত শক্তিশালী হয় তা অনুষ্ঠানে এসে আরও একবার উপলব্ধি করেছে শ্রোতা। অনুষ্ঠানে নজরুলের ‘জীবন বিজ্ঞান’ প্রবন্ধ থেকে পাঠ করে শোনান শান্ত কিন্তু জোরালো কণ্ঠের অধিকারী রামেন্দু মজুমদার।

নজরুলের হয়ে তিনি বলে যান : ‘অন্যের দুঃখ-বেদনা অনুভব করাই হচ্ছে মহত্তর ব্যথার অনুভব...। এ সেই দুঃখ যা পয়গম্বরগণ বিশ্বমানবের অন্তরে অন্তর মিশিয়ে অনুভব করেছিলেন। এর বেদনার আনন্দ প্রকাশের ভাষা নেই। এ-ই হচ্ছে সেই সাধনা, যা মানুষকে দেবত্বে উন্নীত করে। এই  বেদনার গভীর আন্তরিকতাতেই ত্যাগের নির্বিকার প্রশান্তি, এই চির-ব্যথার বনেই আনন্দ-স্পর্শমণি খুঁজে পাওয়া যায়। সকলেই এ অমৃতময় দুঃখ অনুভব করতে পারে না।

মহত্তর আত্মা যাঁদের, ভুক্তভোগী যাঁরা, শুধু তাঁরাই এ হেয়ালির মর্ম বোঝেন।’ অদ্ভুত সুন্দর এই বয়ান সবাইকে নতুন করে জীবনের মানে খুঁজতে যেন অনুপ্রাণিত করে এদিন। অনুষ্ঠানে ছায়ানটের পক্ষে বিশেষ বাণী পড়ে শোনান ডা. সারওয়ার আলী। জাতীয়সংগীতের মধ্য দিয়ে শেষ হয় প্রভাতী এই আয়োজন।  
মঙ্গল শোভাযাত্রায় মানুষের ঢল ॥ ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষ হতে না হতেই মানুষের ঢল নামে চারুকলার সামনের রাস্তায়। বর্ষবরণের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য এই আয়োজনে যোগ দিতে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসে মানুষ। সব বয়সী মানুষ হাসি আনন্দের সঙ্গে শোভাযাত্রায় যোগ দেন। অনেকে আগেভাগে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন। অপেক্ষা করছিলেন। সকাল ৯টা ১৮ মিনিটে শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী শোভাযাত্রা।

শোভাযাত্রার এবারের প্রতিপাদ্য ছিল- ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’। ধর্মান্ধ উগ্র মৌলবাদীদের চোখ রাঙানি তো আছেই, সেইসঙ্গে আরও বহুবিধ অন্ধকার এখন সমাজে। সব অন্ধকার বিনাশ করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শপথে এগিয়ে চলে মঙ্গল শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রার মূল আকর্ষণ ছিল পাঁচটি শিল্প কাঠামো। টেপাপুতুল পাখি হাতি বনরুইসহ একটি ফুলের শিল্প কাঠামো নিয়ে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। সাধারণ মানুষের হাতেও ছিল বিভিন্ন মুখোশ, চরকি ইত্যাদি লোক কারুপণ্য।

শোভাযাত্রায় ঢাক ঢোল বাজছিল। অংশগ্রহকারীরা হাতে হাত ধরাধরি করে নেচেছেন, গেয়েছেন। নাচতে নাচতে, গাইতে গাইতে এগোচ্ছিলেন তারা। শোভাযাত্রা শুরুর প্রাক্কালে চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, এবার ঈদের ছুটির মধ্যেই মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। কিছুটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। তবে মঙ্গল শোভাযাত্রায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ প্রমাণ করেছে বাঙালি অপরাজেয়। সময়মতো জবাব দিতে জানে। সমাজের তিমির বিনাশ করার এই শপথ সারা বছর মনে রাখার আহ্বান জানান তিনি।      
৪১ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে ঋষিজ ॥ সংগীত সংগঠন ঋষিজর আয়োজনে বহু বছর ধরে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে আসছে। সেই ধারাবাহিকতায় শিশুপার্কের সামনে এবারও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এবার ছিল ৪১তম আয়োজন। আয়োজক সংগঠনের শিল্পীরা ছাড়াও খ্যাতিমান অনেকে সংগীত পরিবেশন করেন এখানে। কলকাতা থেকে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন একদল শিল্পী। মাদল নামের লোকগানের দলটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করে অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা ফকির আলমগীরের অবর্তমানে ভবিষ্যতেও অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন ঋষিজর আরেক শিল্পী সংগঠক ফকির সিরাজ।    
প্রতিবাদী অনুষ্ঠান সাংস্কৃতিক জোটের ॥ এবারের পহেলা বৈশাখেও বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিশেষ করে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে উন্মুক্ত স্থানে আয়োজিত সকল অনুষ্ঠান বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছিল তারা। এমন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা বরাবরই অপছন্দ উৎসবপ্রিয় বাঙালির। একই কারণে এবার বড়সড়ো প্রতিবাদ গড়ে তুলতে সক্ষম হয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। পুলিশের নির্দেশনা অমান্য করে রাত নয়টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ।

সেই ঘোষণা অনুযায়ী, রাত ৯টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠান করেন তারা। এখানেও ছিল লোকগান, লোকনৃত্যসহ ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির উপস্থাপনা। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে এটি হয়ে ওঠে প্রতিবাদের প্রতীক। প্রতিবাদের প্রভাব পড়ে অন্যান্য অনুষ্ঠানেও। সন্ধ্যার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে উৎসবপ্রিয়দের সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় পুলিশ।   
আলপনায় বর্ণিল সড়ক ॥ বর্ষবরণ উৎসবের ছোঁয়া লেগেছিল সড়কেও। রাজধানীর মানিক মিয়া এভেনিউতে আগের রাতে আলপনা করা হয়। সকাল হতেই চোখ কপালে। কী বিশাল এলাকা। পুরোটাই আলপনা! হাজার হাজার মানুষ এই আলপনার সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন। এখনো ভিড় লেগে আছে সেখানে। একইভাবে আলপনা করা হয়েছে গুলশানের রাস্তায়। তবে ইতিহস গড়ার অপেক্ষায় রয়েছে কিশোরগঞ্জের হাওড়পাড়ে করা আলপনা। ১৪ কিলোমিটার সড়কে আলপনা করা হয়েছে, যা একটি নতুন রেকর্ড হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। শিল্প সংস্কৃতির চর্চা তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়ার এই প্রয়াস প্রশংসিত হচ্ছে সর্বত্র।  
গ্রামীণ ঐতিহ্যের মেলা ॥ পহেলা বৈশাখে লোকঐতিহ্য মেনে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বৈশাখীমেলার আয়োজন করা হয়। শাহবাগের রাস্তার দুই ধারে সকাল থেকেই বসেছিল লোকজ পণ্যের পসরা। গ্রামের মেলায়  দেখা বিভিন্ন খেলনা, বাঁশি, পুতুল, হাতপাখা ইত্যাদি আগ্রহ নিয়ে কিনছিলেন উৎসবপ্রেমীরা। হাইকোর্ট সংলগ্ন ফুটপাতের দোকানগুলোতেও বিক্রি ছিল জমজমাট। টিএসসিতে কাঁচের চুড়ির দোকানগুলোতে ভিড় করেছিলেন তরুণীরা। হাত ভর্তি করে চুড়ি পরতে দেখা গেছে তাদের। 
খোলা হয় শুভ হালখাতাও ॥ পহেলা বৈশাখে হালখাতা খুলেছেন পুরান ঢাকার সনাতন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্য দিয়ে নবোদ্যমে যাত্রা শুরু করেছেন তারা। বায়তুল মোকাররম এলাকার স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা আমন্ত্রণ করেছিলেন তাদের নিয়মিত ক্রেতাদের। ইসলামপুরের কাপড়ের গদিতে হয়েছে শুভ হালখাতার আনুষ্ঠানিকতা। এদিন পাইকারি ক্রেতারা পাওনা  শোধ করেছেন। সেইসঙ্গে পণ্য কিনে নতুন হিসাব খুলেছেন অনেকে। এমনকি বাংলাবাজারের বই প্রকাশকরা হালখাতা উপলক্ষে পহেলা বৈশাখে বড় ছাড়ে বই বিক্রি করেছেন। 
ঘরে ঘরে ছিল বিশেষ খাবার ॥ অনেকে এদিন পরিবার পরিজনের সঙ্গে নিজের মতো করে সময় কাটিয়েছেন। গ্রামীণ ঐতিহ্যের বহু পদ রান্না করা হয়েছিল বাসা বাড়িতে। ভর্তা ভাজি মাছ শাক শুঁটকি কাঁচা আম দিয়ে ডাল- কিছুই বাদ যায়নি। ছিল ইলিশ ভাজিও। আত্মীয় পরিজনদের নেমন্তন্ন করে খাওয়াতেও দেখা গেছে। 
সব মিলিয়ে অভাবনীয় জাগরণ। পহেলা বৈশাখের এই জাগরণ বাঙালির আগামী দিনগুলোকে প্রভাবিত করবে। প্রগতির পথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি জোগাবে- সকলের তাই প্রত্যাশা।

×