ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

রাজধানীর ৯০ ভাগ রেস্তোরাঁই ঝুঁকিপূর্ণ

আজাদ সুলায়মান

প্রকাশিত: ২৩:৪২, ৩ মার্চ ২০২৪

রাজধানীর ৯০ ভাগ রেস্তোরাঁই ঝুঁকিপূর্ণ

ধানমন্ডির এই বহুতল ভবনের প্রতি তলায়ই রয়েছে একাধিক রেস্টুরেন্ট

ঢাকায় রাজউক এলাকায় ৫ লাখ ১৭ হাজার ভবন রয়েছে। এসব ভবনের মধ্যেই রয়েছে ছোট-বড় ২৫ হাজার রেস্তোরাঁ। যেগুলোতে প্রতিদিন ভিড় করে শ্রমজীবী থেকে বিত্তবান মানুষ পর্যন্ত। রাজধানীর আবাসিক এলাকাতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এই ২৫ হাজার রেস্তোরাঁ। এগুলোর মধ্যে আবার ৮০ ভাগেরই নেই অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। একটি রেস্তোরাঁ চালু করতে যেসব শর্ত অনুসরণ করতে হয়, সেগুলো মানা হচ্ছে না।

বারবার অগ্নি দুর্ঘটনার পর এসব শর্তাদি পূরণে বিভিন্ন সংস্থার তাগিদ থাকলেও সময়ের ব্যবধানে সেটাও স্তিমিত হয়ে আসে। বেইলি রোডের ভয়াবহ আগুণের পর আবারও বেরিয়ে আসছে কার দোষ কতটুকু, কে কতটুকু আইন অমান্য করেছেন। এখন টক শো থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সর্বত্রই বলা হচ্ছে, রাজউক আর দমকলই মূলত দায়ী। অন্যান্য সংস্থার দায় থাকলেও এ দুটি সংস্থা কিছুতেই আগুনের দায় এড়াতে পারে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে যে ২৫ হাজারের বেশি হোটেল-রেস্তোরাঁ রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ৯০ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ।

এগুলো এতটাই ঝুকিপূর্ণ যে, এখন রাজউক আর ফায়ার সার্ভিস ইচ্ছে করলেও রাতারাতি বা এক বছরেও এগুলোকে ঝুঁকিমুক্ত করতে পারবে না। রাজউকের একজন মাঠপর্যায়ের পরিদর্শক  নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, এসব ভবন আর রেস্তোরাঁর পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, এখন সরকার চাইলেও রাতারাতি কিছু করতে পারবে না। এসব রেস্টুরেন্ট না যাবে বন্ধ করা, না যাবে ফায়ার সেফটি চালু করা। তাহলে বিষয়টা কি দাঁড়াল ? আগামী কয়েক বছর নগরবাসীকে এমন অগ্নিকা-ের ঝুঁকিতে থাকতে হবেÑ এটাই বাস্তবতা। 
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইমরান হাসান বলেন, ঢাকায় যে ২৫ হাজার ছোট-বড় রেস্টুরেন্ট রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে পাঁচ হাজার নিবন্ধিত থাকলেও এগুলোর মধ্যে মাত্র শতকরা পাঁচভাগে ফায়ার সেফটি বা অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। এই পরিসংখ্যান থেকেই আঁচ করা যায়, পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ। এ থেকে শীঘ্র বের হওয়াটা বেশ জটিল। 
জানতে চাইলে রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান্য নূরুল হুদা বলেন, হয় অগ্নি আইন মানাতে হবে, না হয় বন্ধ করে দিতে হবে ঝুঁকিপূর্ণ রেস্টুরেন্ট। নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। রেস্টুরেন্ট কেন এত ঝুঁকিপূর্ণ জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক আলী আহমদ খান বলেন, একে তো আবাসিক এলাকায় যে কোনো রেস্টুরেন্ট ঝুঁকিপূর্র্ণ, তারপরও যদি করতেই হয়, তাহলে ফায়ার সেফটি মেনেই করতে হবে।

যেমন কোথায় চুলা বসবে, ধোঁয়া নির্গমন হবে কোন দিক দিয়ে, সিলিন্ডার চুলা থেকে কতটা দূরত্বে থাকবে, যারা কাজ করবে তাদেরকে অগ্নি নির্বাপণ প্রশিক্ষণ দেওয়া, জরুরি নির্গমন পথ বা সিঁড়ি রাখা ছাড়াও বিস্ফোরক অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সংস্থার অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু রাজধানীতে কয়টি রেস্টুরেন্টে এসব মানা হচ্ছে? 
এ বিষয়ে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের উদাহরণ টেনে ফায়ার সার্ভিসের একটি সূত্র জানায়, সেখানে ফায়ার সেফটির বালাই ছিল না। যেভাবে সেখানে সিলিন্ডার থেকে গ্যাসের চুলা জ্বালানো হতো, তা ছিল রীতিমতো একটা আগ্নেয়গিরি। 
ভবনটির সব রেস্টুরেন্টের মালিকরা রান্না করার জন্য গ্যাস সিলিন্ডার বা চুলা ব্যবহারে ফায়ার সার্ভিস থেকে কোনো অনুমতিপত্র গ্রহণ করেননি। তারা সবাই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দোকান পরিদর্শক কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে অবৈধভাবে রেস্টুরেন্ট স্থাপন করেন। গ্যাসের চুলা ও সিলিন্ডার ব্যবহার করে দেদার ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিলেন তারা। যার ভয়ংকর পরিণতি ঘটে বৃহস্পতিবার রাতে।

যেখানে ৪৬ জন নিরীহ প্রাণ ভস্মীভূত হয়। ওই ভবনটির স্বত্বাধিকারী ও ম্যানেজার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমোদন ছাড়া বেশকিছু রেস্টুরেন্ট এবং দোকান ভাড়া দেয়। রেস্টুরেন্টগুলো যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যতিরেকে রান্নার কাজে গ্যাসের সিলিন্ডার এবং চুলা ব্যবহার করে থাকে। রেস্টুরেন্ট মালিকরা ভবনটির নিচতলায় বিপুল পরিমাণে গ্যাস সিলিন্ডার মজুত করেন।

জননিরাপত্তার তোয়াক্কা না করে তারা বেপরোয়া এবং বিপজ্জনকভাবে এই গ্যাস সিলিন্ডার এবং গ্যাসের চুলা ব্যবহার করে আসছিল। রাজধানীর হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোতে ফায়ার সেফটির ন্যূনতম ব্যবস্থা না থাকলেও বেইলি রোডের ঘটনার পর এখন নতুন করে চ্যালেঞ্জে পড়তে হচ্ছে মালিকদেরকে। এত রেস্টুরেন্টের যে  অনিয়ম আর ত্রুটি রয়েছে, সেগুলো শনাক্ত করতেই সময় লেগে যাবে কয়েক বছর। প্রশ্ন হচ্ছে, এই কয়েক বছর তাহলে কীভাবে চলবে? সমাধান কী এর?

এগুলো বন্ধ করে দেওয়া, নাকি ঝুঁকির মধ্যে নগরবাসীকে বসবাস করতে বাধ্য করা। নগরবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, এটা খুব কঠিন হলেও সরকার চাইলে একটা সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই একটা সমাধান করা সম্ভব। যেমন রানা প্লাজা ধসের পর মাত্র ছয় মাসের মধ্যে গার্মেন্টস খাতের কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেই দায়িত্ব পালন করে। ঠিক একইভাবে রেস্টুরেন্টগুলোতে ফায়ার সার্ভিস তৃতীয় কারোর সহায়তায় এটা বাস্তবায়ন করতে পারে। এ জন্য দরকার শুধু সদিচ্ছার। 
জানতে চাইলে বুয়েট দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, এ বিষয়ে টাস্কফোর্স গঠনের পরামর্শ দিয়ে বলেন, অনেকগুলো সংস্থার অবহেলায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন জায়গায় অযোগ্য, অদক্ষ ও দুর্নীতিবাজদের কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা শহরের ব্যবস্থাপনা বলতে গেলে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।

একটা শহরে কত ধরনের কর্তৃপক্ষ আছে, কেউ দায়িত্ব নিয়ে কাজটা করছে না। তিতাস, রাজউক, ওয়াসা, পুলিশ, বিআরটিএ, পরিবেশ অধিদপ্তর- যাদের যা দায়িত্ব তারা তা পালন করছে না। ফলে দিন দিন শহরটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। এখন ঢাকা শহরের যে অবস্থা তাতে কোনো কর্তৃপক্ষই এককভাবে দায়িত্ব নিয়ে কাজটা করতে পারবে না। এত ভবন তদারকির সুযোগও তাদের নেই। ফলে এই মুহূর্তে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটা টাস্কফোর্স করতে হবে।

একটি ভবন করতে হলে যে সাতটি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নিতে হয়, তাদের এই টাস্কফোর্সে রাখা যাবে না। টাস্কফোর্সের অধীনে তাদের জবাবদিহি করতে হবে। এখন বিশেষজ্ঞরা কীভাবে কাজটা করবেন? বিশ্বের অন্য দেশের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে তদারকিতে নিযুক্ত করতে হবে। অবশ্যই ওই প্রতিষ্ঠানের দক্ষ জনবল থাকতে হবে। যেভাবে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের তত্ত্বাবধানে ঘুরে দাঁড়িয়েছে গার্মেন্টস সেক্টর। 
রেস্টুরেন্টের অগ্নিঝুঁকি ও নিরাপত্তা সম্পর্কে বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মো. মাকসুদ হেলালী বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতে এলপিজি গ্যাসের ব্যবহার বেশি। এখন এটি গ্রামাঞ্চলেও ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন আর লাকড়ির সাধারণত ব্যবহার নেই বললেই চলে। সবাই এখন এলপিজি গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। এটির ব্যবহার সম্পর্কে অনেকেই জানে না। যার কারণে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে।

এলপিজি গ্যাসের ধোঁয়া যখন হলুদ রং হবে, তখন বুঝতে হবে ওই এলপিজি গ্যাসের সিলিন্ডারে সমস্যা আছে। নীল হলে সমস্যা তেমন নেই। এটি অনেকেই জানেন না। আমাদের মধ্যে আইন না মানার প্রবণতা অনেক বেশি। ভবন নির্মাণ ও ভবন ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিয়ম মানার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। 
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, গোটা ঢাকা থাকার কথা ছিল আবাসিক হিসেবে। কিন্তু এটা এখন হয়ে গেছে বাণিজ্যিকে। এ জন্যই এখন দুভাগে ভাগ করতে হবে। বাণিজ্যিক ভবনগুলোর মধ্যে বহুতল ভবনগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। সেই কাজ যদি সরকার একা না করতে পারে তাহলে থার্ড পার্টি এখানে যুক্ত করা যেতে পারে। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকনিক্যাল সাবজেক্টের শিক্ষার্থীদের।
এদিকে রেস্টুরেন্টগুলোতে ফায়ার সেফটি নিশ্চিত করার বিষয়টি এত কঠিন কেন যেগুলো মানুষ বরাবরই উপেক্ষা করছে। কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ করলেও একজন রেস্টুরেন্ট মালিক ফায়ার সেফটি নিয়ে মাথা ঘামাতে চায়  না। কিন্তু কেন ? 
জানতে চাইলে রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল হুদা বলেন, শুধু হোটেল  নয়, যে কোনো ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যাপারে জাতীয় বিল্ডিং কোডে অনেক নির্দেশনা দেওয়া আছে।

ঢাকার ৮০ শতাংশ ভবনে তা মানা হচ্ছে না। আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে অগ্নি দুর্ঘটনায় এত হতাহত হতো না। তবে সিটি করপোরেশন যখন ওই সব ভবনে ট্রেড লাইসেন্স দেয়, তিতাস গ্যাস ও বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ দেয়, তখন তারা বিষয়টি পর্যালোচনা করতে পারে।

×