ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

গাইবান্ধায় নির্বাচনী উত্তাপ

আবু কায়সার শিপলু, গাইবান্ধা

প্রকাশিত: ০১:১৫, ১ ডিসেম্বর ২০২৩

গাইবান্ধায় নির্বাচনী উত্তাপ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গাইবান্ধায় মনোনয়নপ্রাপ্তদের পদচারণায় বিরাজ করছে ভোটের আমেজ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গাইবান্ধায় মনোনয়নপ্রাপ্তদের পদচারণায় বিরাজ করছে ভোটের আমেজ। গ্রামে-গঞ্জ, মহল্লার চায়ের দোকান, টেবিল থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস সবখানেই এক আলোচনা কে হচ্ছেন তাদের নেতা। নতুন এমপিরা কি পারবেন গাইবান্ধাকে বসবাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে? তারা কি পারবেন যানজটমুক্ত দূষণমুক্ত একটি নিরাপদ এলাকা ভোটের আগে এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ ভোটারদের মনে। সরেজমিনে দেখা যায়, গাইবান্ধায় বিভিন্ন গ্রামের বাসায়, চায়ের দোকানে এখন আলোচনার একমাত্র বিষয় নির্বাচন। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ছে এসব প্রচারণা। গাইবান্ধার বিভিন্ন চায়ের দোকানে এবং হাটবাজারে গ্রামের মোড়ে মোড়ে এখন নির্বাচন নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। এদিকে মনোনয়নের সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থীরা নেতা-কর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। এমনকি মোটরসাইকেল দিয়ে শোডাউন চালাচ্ছেন।
গাইবান্ধায় ৫টি সংসদীয় আসনে ৫২ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করলেও শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পেয়েছেন ৫ জন। আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রাপ্তরা হচ্ছেন গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফরুজা বারি, গাইবান্ধা-২ (গাইবান্ধা সদর) জাতীয় সংসদের হুইপ ও বর্তমান সংসদ সদস্য মাহাবুব আরা বেগম গিনি, গাইবান্ধা-৩ (সাদুল্লাপুর-পলাশবাড়ী) কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ স¤পাদক বর্তমান সংসদ সদস্য উম্মে কুলসুম স্মৃতি, গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ, গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বর্তমান সংসদ সদস্য মাহমুদ হাসান রিপন।
প্রতিদিনই উঠান বৈঠক এবং ভোটারদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে মাঠে দেখা যাচ্ছে একই দলের বেশ কয়েকজন প্রার্থীকে। গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফরুজা বারি, তিনি এবার নতুন মুখ। তবে লোকজনের কাছে তার প্রভাব খুব বেশি। যদিও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সৈয়দা খুরশিদ জাহান স্মৃতি এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। এতে ভোটের ফলাফল কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে অনেকে ভাবছেন।

অপরদিকে এ আসনে জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন রংপুর বিভাগীয় অতিরিক্ত মহাসচিব ও বর্তমান এমপি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, ২০১৭ সালের উপনির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আফরুজা বারীকে পরাজিত করে জয়ী হন জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। এর পর ২০১৮ সালে মহাজোটের শরিক হিসেবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে আবারও এমপি নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী।

আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে সরগরম হয়ে উঠেছে গাইবান্ধা ২ আসনটিও। লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় এখানে নির্বাচন জমে উঠবে। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের কাছে হারানো গাইবান্ধা-২ (সদর) আসনটি এবার নিজেদের কবজায় নিতে মরিয়া জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা। গাইবান্ধা-২ (সদর) আসনে সাবেক এমপি আবদুর রশিদ সরকার, নমিনেশন পেয়েছেন। 
এদিকে সরকারের চলমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতা কাজে লাগিয়ে মনোনয়ন দৌড়ের পাশাপাশি ভোটারদের কাছে ছুটছেন ক্ষমতাসীন দলের ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে পরপর দুবার আওয়ামী লীগের মাহাবুব আরা বেগম গিনি। দলের কাছে নিজের ইমেজ তুলে ধরতে পালন করছেন সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি। বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে গাইবান্ধা সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ গণপরিষদের প্রথম ¯িপকার শাহ আবদুল হামিদের নাতি শাহ সারোয়ার কবীর এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দেখা যেতে পারে। এতে ভোটের ফলাফল কোন দিকে যাবে বোঝা দায়।

জাতীয় পার্টির পুরনো ঘাঁটি হলেও বর্তমানে গাইবান্ধা ৩ আসনটি আওয়ামী লীগের দখলে। যদিও দলটিতে রয়েছে সাংগঠনিক গ্রুপিং। সেটা কাজে লাগিয়ে আবারও আসনটি উদ্ধারের চেষ্টা করবে জাপা। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল থেকে এ আসনে মনোনয়নপ্রাপ্ত বর্তমান সংসদ সদস্য উম্মে কুলসুম স্মৃতি। তার কথা লোকমুখে শোনা যাচ্ছে। তবে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে পলাশবাড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান এ কে এম মোকছেদ চৌধুরী বিদ্যুতের কথা বেশি শোনা যাচ্ছে। মহল্লার চায়ের টেবিল থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস সবখানেই তাকে নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। তবে এ আসনের জাতীয় পার্টির নতুন মুখ প্রয়াত ড. টিআইএম ফজলে রাব্বি চৌধুরী এমপির ছেলে ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য প্রকৌশলী মইনুর রাব্বী চৌধুরী রুমান নমিনেশন পেয়েছেন। এতে ভোটের ফলাফল কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসতে পারে অনেকে ধারণা করছেন।
গাইবান্ধা ৪ আসনটি দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির কাছ থেকে এ আসনটি পুনরুদ্ধার করে আওয়ামী লীগ। এবার এ আসনে নমিনেশন পেয়েছেন গতবারের স্বতন্ত্র, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ। সরেজমিনে দেখা যায়, তাকে এমপি হিসেবে আবারও দেখতে চান অনেকে। প্রতিদিন মোটরসাইকেল শোডাউন ও মিছিল বের করছেন তার সমর্থকরা। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন। রংপুর আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন চৌধুরী নবম সংসদ নির্বাচনে এবং অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ (স্বতন্ত্র, আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী) দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন।

রংপুর চিনিকলের বাগদা ফার্মের সাঁওতাল পল্লীতে হামলা মামলায় বিতর্কিত হয়ে মনোনয়নবঞ্চিত হন অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ। ফলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবারও প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন চৌধুরী আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। তবে মনোয়ার হোসেন চৌধুরী স্বতন্ত্র, বিদ্রোহী প্রার্থী  হিসেবে ভোট করলে এবারও তিনি নির্বাচিত হতে পারেন বলে অনেকে ধারণা করছেন। 
অপর একজন বিদ্রোহীপ্রার্থী মনোনয়ন না পেয়েও এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ প্রধান নির্বাচন করছেন। দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে ছুটছেন ভোটারদের কাছে। তিনিও নির্বাচিত হতে পারেন বলে অনেকের কাছে জানা যায়। দলীয় সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা ও জনসাধারণের সঙ্গে মিশে চলায় হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল লতিফকেই মনে করা হচ্ছে। এ আসন থেকে জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন উপজেলা কমিটির আহ্বায়ক অধ্যক্ষ কাজী মো. মশিউর রহমান।
গাইবান্ধা ৫ আসনটি বছরের শুরুতে ৪ জানুয়ারির উপনির্বাচনে জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহমুদ হাসান রিপন। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে দলের নেতা-কর্মীসহ এলাকার ভোটারদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন তিনি। পাশাপাশি নির্বাচিত হওয়ার পর স্বল্প সময়ে এলাকার রাস্তা, নদীভাঙন রোধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করায় জনগণের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন তিনি। এইবারও তিনি মনোনয়ন পেয়েছেন। সরেজমিনে দেখা গেছে, নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, প্রতিদিন প্রতিটি ওয়ার্ডে হচ্ছে তার সমর্থকদের উঠান বৈঠক অথবা পথসভা। প্রতিদিনেই চলছে মিছিল ও মোটরসাইকেল শোডাউন। পাড়া মহল্লার চায়ের দোকানগুলোতে সকাল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত চলে ভোটারদের গাল-গল্প। তারা মাহমুদ হাসান রিপনকে আবারও এমপি হিসেবে দেখত চায়। 
এ আসন জাতীয় পার্টির দুর্গ হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘদিন নিজেদের দখলে থাকলেও ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে আসনটি হারায় জাতীয় পার্টি। তাই আবারও আসনটি দখলে নিতে মরিয়া জাতীয় পার্টি। এবার জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা। 
চা-বিস্কুটের আড্ডার সঙ্গে চলছে প্রার্থীদের চুলচেরা বিশ্লেষণ। ভোটের নানা সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত প্রার্থীর সঙ্গে কর্মীরাও। এ আসনে হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের মাহমুদ হাসান রিপন ও জাতীয় পার্টির স্বতন্ত্র প্রার্থী এ এইচ এম গোলাম শহীদ রঞ্জুকে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছেন স্থানীয়রা। এছাড়া প্রয়াত সংসদ সদস্য এবং সাবেক ডেপুটি ¯িপকার ফজলে রাব্বীর মেয়ে ফারজানা রাব্বী বুবলি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোট করলে নির্বাচন জমজমাট লড়াই হবে বলে অনেকে আশা করেন।
অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া এবং ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আবারও অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া পুনরায় নির্বাচিত হন। ২০২২ সালে অসুস্থতার কারণে তার মৃত্যু হলে ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি উপনির্বাচনে জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহমুদ হাসান রিপন।
আবু কায়সার শিপলু, গাইবান্ধা

×