ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

কুড়িগ্রাম জেলা

আওয়ামী লীগ ও জাপার তৎপরতা বেশি, অনিশ্চয়তায় বিএনপি

রাজু মোস্তাফিজ, কুড়িগ্রাম

প্রকাশিত: ০০:০৯, ১ নভেম্বর ২০২৩

আওয়ামী লীগ ও জাপার তৎপরতা বেশি, অনিশ্চয়তায় বিএনপি

দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নদ-নদী বেষ্টিত কুড়িগ্রাম জেলায় চারটি সংসদীয় আসন

দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নদ-নদী বেষ্টিত কুড়িগ্রাম জেলায় চারটি সংসদীয় আসন। এই আসনগুলোতে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তৎপরতা শুরু হয়েছে। চলছে সর্বত্রই আলোচনা। প্রার্থীর দোষ, গুণ, কোন দল থেকে কে পাচ্ছেন দলীয় মনোনয়ন, কাকে মনোনয়ন দিলে জিতবে আবার কাকে মনোনয়ন দিলে হারবে-এমন আলোচনা প্রায় সব জায়গাতেই। 
এক সময় কুড়িগ্রাম জেলা জাতীয় পার্টির ঘাঁটি থাকলেও এখন বদলে গেছে সেই চিত্র। 
দলীয় কোন্দল আর একাধিক প্রার্থী নিয়ে অনেকটাই অগোছালো আওয়ামী লীগ। একাধিক আসনে বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী থাকায়  পিছিয়ে নেই বিএনপিও। তবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রশ্নে প্রার্থীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা কাজ করছে।  আর জাতীয় পার্টি তাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে এবার মরণ কামড়  দেবে-এমন আলোচনা রাজনৈতিক মহলে। কুড়িগ্রামে চরমোনাইর পীরের অনেক অনুসারী থাকায় সাম্প্রতিক কয়েক বছরে ভোটের মাঠে তারাও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছেন। বিপুল ভোটব্যাংকের কারণে কোনো কোনো আসনে তাদের প্রার্থীরাও জয়ের ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী। শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে আসনটিতে ত্রিমুখী লড়াই হতে পারে।
নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নিয়ে কুড়িগ্রাম-১ সংসদীয় আসন। এই আসনে একচ্ছত্র আধিপত্য রেখে ছিল জাতীয় পার্টি। আওয়ামী লীগের দখলে যাওয়া এই আসনটি সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমানের (মোস্তাক) ওপর ভর করেই আবারও ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে জাপা। অন্যদিকে বর্তমানে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আসলাম হোসেন সওদাগরের নানা কর্মকা-ে বহুবার আলোচিত সমালোচিত হয়েছেন। এ আসনে আওয়ামী লীগের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে বলে মনে করেন সাধারণ ভোটাররা। তারা মনে করেন এ আসনে এবার আওয়ামী লীগের যোগ্য ও ত্যাগী প্রার্থীকে মনোনয়ন দিলে আসনটি পুনরুদ্ধার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কুড়িগ্রাম-১ আসনে বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নেয় তবে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বিএনপির প্রার্থী একাধিক না হলেও তাদের দলের আভ্যন্তরীণ কোন্দলে চরম বিপর্যয়ে পড়েছে দলটি। অবস্থা এমন কেউ কাউকে মানতে চাইছে না। যদিও নির্বাচনে জামায়াত এর ভোট বিএনপি প্রার্থীই পাবে এ আসনে। 
আগামী সংসদ নির্বাচনে এ আসনটি জাতীয় পার্টির দখলে নেওয়ার লক্ষ্যে সাবেক এমপি মোস্তাকের ওপরই ভরসা করছে দলটি। তৃণমূলে জনপ্রিয় সাবেক এই এমপির দলীয় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই বলে দলটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এদিকে কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা ‘৯৬ নির্বাচনে জয়ী হয়েও সংসদ সদস্য হিসেবে মেয়াদ পূর্ণ না করার অতৃপ্তি মেটাতে আবারও এই আসনে লড়বেন বলে জানা গেছে।

কুড়িগ্রাম সদর হচ্ছে কুড়িগ্রাম-২ আসন। এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসন। জেলাজুড়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় অভিভাবক হিসেবে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাফর আলীকে সংসদ সদস্য হিসেবে চায়। তবে জাতীয় পার্টি এ আসনটি ছেড়ে দিতে নারাজ। এ আসনে বর্তমানে এ দলের এমপি পনির উদ্দিন আহমেদ। তিনি জোর লবিং করছেন। জাতীয় পার্টিতে অপর একজন প্রার্থী  মেজর (অব.) আব্দুস ছালাম চেষ্টা করছেন মনোনয়ন পাওয়ার। তিনি যথেষ্ট আশাবাদী বলে জানিয়েছেন। এ আসনে বিএনপির একাধিক প্রার্থী থাকলেও তারা কেন্দ্রের নির্দেশনার দিকে চেয়ে আছে । এক সময় কুড়িগ্রাম জেলা জাতীয় পার্টির ঘাঁটি থাকলেও এখন বদলে গেছে সেই চিত্র। আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাপক উন্নয়নে সাধারণ মানুষ চায় এবারও আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করুক। পাশাপাশি সৎ এবং ক্লিন ইমেজের নেতাও চান তারা। 
যদি মহাজোট এবারও হয় তবে জাতীয় পার্টিই এই আসনে প্রার্থী হবে। তারা কোনো অবস্থায় আওয়ামী লীগকে ছাড়  দেবে না। এ এ ছাড়া আসনে আরও চেষ্টা করছেন অধ্যক্ষ রাসেদুজ্জামান বাবু। সাবেক রাকসুর নেতা পিপি অ্যাডভোকেট আব্রহাম লিংকন, জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান আমান উদ্দিন মনজু। তারা গ্রামে গঞ্জে ঘুরে ঘুরে আওয়ামী লীগের উন্নয়নের কথা বলছেন। তারা মনে করেন সরকার দলকে আরও শক্তিশালী করতে প্রার্থীদের বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে এবার মনোনয়ন  দেবেন। সকলের একই কথা নেত্রী যাকে মনোনয়ন দেবেন তার জন্যই কাজ করবেন সবাই একান্তভাবে। 
এদিকে আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত প্রার্থী নিয়ে চিন্তার কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা। তারা আন্দোলনের মধ্যে আছেন এবং আন্দোলন সফল হওয়ার পরই প্রার্থী নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবেন। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা এবং সহসভাপতি শফিকুল ইসলাম বেবু সহমত পোষণ করেন। যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক হাসিবুর রহমান জানান এ আসনে প্রচুর বিএনপির ভোটার রয়েছে। 
উলিপুর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ও উলিপুর পৌরসভা নিয়ে কুড়িগ্রাম-৩ আসন। বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের আব্দুল মতিন। তার বিতর্কিত কর্মকা-ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ বিব্রত। এ কারণে আওয়ামী লীগ এবার আসনটিতে অন্য কোনো ত্যাগী নেতাকে চায়। আওয়ামী লীগের নেতারা এ ব্যাপারে কেন্দ্রে জোর লবিং করছেন। স্থানীয় সাধারণ ভোটাররা মনে করেন এই আসনে এমনিতেই আওয়ামী লীগের অবস্থান অনেক ভালো। শুধু স্থানীয় নেতৃবর্গের সমন্বয়হীনতার কারণে নানা প্রভাব পড়েছে।

ভোটের সময় এবার আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ইসলামিক শাসনতন্ত্র ও জাতীয় পাটির প্রার্থীদের মাঝে চতুরমুখী লড়াই হবে। আসনটিতে ব্যাপক উন্নয়ন করেছে বর্তমান সরকার। উলিপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আহসান হাবীব রানা দীর্ঘদিন থেকে মাঠের রাজনীতি করেছেন। এবার তিনি এই আসনে মনোনয়ন চাইবেন বলে শোনা যাচ্ছে। 
এদিকে বিএনপির অনেক নেতাই মনোনয়ন চাইলেও জেলা বিএনপির সভাপতি শিল্পপতি তাসবিরুল ইসলাম মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে। তিনি যদি মনোনয়ন পান তাহলে শেষ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি শিল্পপতি তাসবিরুল ইসলামের। তবে চর মোনাইয়ের প্রার্থী ডা. আক্কাস আলী। এবার এ আসনে একটি ফ্যাক্টর হতে পারেন। ডা. আক্কাসের এলাকায় জনপ্রিয়তা থাকলেও তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন ইসলামী শাসনতন্ত্রের ব্যনারে। এই আসনে জাতীয় পার্টি যদি মহাজোটের সঙ্গে না যায় তা হলে এককভাবে তাদের কোনো প্রার্থীর জয়লাভ করার সম্ভাবনা কম। 

কুড়িগ্রাম-৪ আসন (রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলা এবং চিলমারী উপজেলার নয়াহাট, অষ্টমীচর ও উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত) এক সময়ে আসনটি জাতীয় পার্টি লাঙ্গলের দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল। বর্তমান এমপির নামে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থকদের কোনো গুরুত্বই দেন না। এলাকার একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তার নিজস্ব কিছু দলীয় নেতাকর্মী ও আত্মীয়-স্বজন বালু উত্তোলন, নিয়োগবাণিজ্যসহ সব কাজেই প্রভাব খাটায়। 
এই আসনের লাঙ্গলের ভোটাররাই এখন আ’লীগের। আসন বিন্যাসের পর এলাকার সিংহভাগ মানুষ আ’লীগের, শেখ হাসিনার সমর্থক এবং এক একটা কর্মী হয়ে উঠছে। ব্যাপক উন্নয়ন করেছে বর্তমান সরকার। সাধারণ ভোটাররা চায় একজন যোগ্য নেতা। উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের লুটপাট আর ভাগবাটোয়ারা নিয়ে অতিষ্ঠ সাধারণ ভোটাররা। দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন ওইসব নেতাদের ওপর। দলের অনেক নেতাকর্মী এবং সাধারণ ভোটাররা জানান, ভালো একজন প্রার্থী যার বিরুদ্ধে দুর্নীতি স্বজনপ্রীতির অভিযোগ নেই। যিনি দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের গুরুত্ব দেবেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন না, এলাকার উন্নয়নের জন্য কাজ করবেন-এমন ব্যক্তিকে আ’লীগ থেকে মনোনয়ন দিলে অনায়াসে জিতে যাবে। 
আ’লীগ আরও যারা মনোনয়ন চাইবেন তারা হলেন, মো. জাকির হোসেন বর্তমান এমপি, কুড়িগ্রাম বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন, মো. বিপ্লব হোসেন, আনোয়ার হোসেন, শফিউল আলম, হাজী মো. মুরাদ লতিফ, রেজাউল করিম মিনু, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই প্রমুখ। এ আসনে বিএনপির কয়েকজন নেতা মনোনয়নপ্রত্যাশী হলেও তাদের দল নির্বাচনে যাবে কিনা তাতে অনিশ্চতায় ভুগছে। তবে এ আসনে বরাবর জামায়াত নেতা জোটের প্রার্থী হিসাবে নিার্বচন করে আসছে। এবার যদি বিএনপি শেষ মূহূর্তে নির্বাচনে যায় তা হলে তারা তাদের প্রার্থীর জন্য জোর দাবি করবে।  

এবার বিএনপির মনোনয়নপ্রার্থী হিসেবে উপজেলা বিএনপির সভাপতি আজিজার রহমান, রাজিবপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মোখলেছুর রহমান, চিলমারী উপজেলা বিএনপির  সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল বারী, রৌমারী উপজেলা বিএনপির সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান রনজু, রৌমারী উপজেলা সহসভাপতি আবুল হাশেম, রৌমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ঈমান আলী। 
জাতীয় পার্টি-জেপির প্রার্থী রুহুল আমিন এ আসনে প্রার্থিতার জন্য মনোনয়ন চাইবে। জেপির সাংগঠনিক কোনো কার্যক্রম নেই বললেই চলে। শুধু পারিবারিক কারণে রুহুল আমিনের ওই অবস্থান। এখানে জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান অবস্থা খুবই খারাপ। বিএনপির ২০ দলীয় জোট থেকে বারবার জামায়াতের প্রার্থী দিলে একবারও জিততে পারেনি। রাজীবপুরের নয়াচর ও রৌমারীর দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে জামায়াত শিবিরের শক্ত ঘাঁটি রয়েছে।

×