ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৬ মে ২০২৫, ২৩ বৈশাখ ১৪৩২

ক্ষতিপূরণ ও দোষীদের শাস্তি দাবি

রানা প্লাজা ধস মামলার বিচার শেষ হয়নি দশ বছরেও

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ২৪ এপ্রিল ২০২৩

রানা প্লাজা ধস মামলার বিচার শেষ হয়নি দশ বছরেও

সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা ও ইমারত বিধির মামলার বিচার শেষ হয়নি এক দশকেও

সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা ও ইমারত বিধির মামলার বিচার শেষ হয়নি এক দশকেও। উচ্চ আদালতের আদেশে প্রায় ছয় বছর স্থগিত থাকার পর গতবছর হত্যা মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। এরপর বিচারে কিছুটা গতিও আসে। তবে ইমারত বিধি না মেনে ভবন তৈরির মামলার কার্যক্রম উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত রয়েছে। রানা প্লাজা ধসের পরপর বেশ কয়েকটি মামলা হলেও এ দুটিই মূল মামলা। দুই মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানা কারাগারে থাকলেও অধিকাংশ আসামি জামিনে বা পলাতক রয়েছেন। মামলার মূল আসামি সোহেল রানাও সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছিলেন। তবে আপিল বিভাগ সেই জামিন স্থগিত করে দেওয়ায় এখনো মুক্তি পাননি তিনি।

সোমবার রানা প্লাজা ধসের ১০ বছরপূর্তি উপলক্ষে নিহতদের স্মরণ করেছেন তাদের স্বজনরা, আহত শ্রমিক, বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এদিন সকাল থেকে রানা প্লাজার সামনে অবস্থিত অস্থায়ী বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান আহত-নিহতদের স্বজন ও শ্রমিক নেতারা। এ সময় তারা ক্ষতিপূরণ ও ভবন মালিকসহ দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে কর্মসূচি পালন করেন। 
রানা প্লাজা একটি বাণিজ্যিক ভবন হলেও এর ভূগর্ভস্থ তলায় গাড়ি রাখার জায়গা, প্রথম তলায় ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়, দ্বিতীয় তলায় বিপণিকেন্দ্র এবং তৃতীয় থেকে সপ্তম তলা পর্যন্ত পোশাক কারখানা ছিল। এর ওপরের দুটি তলা খালি ছিল। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে মার্কেটের বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ থাকলেও খোলা ছিল তৈরি পোশাক কারখানা। ফলে দুর্ঘটনায় ইট-কংক্রিটের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে মুহূর্তেই হারিয়ে যায় হাজারেরও বেশি প্রাণ। আবার সৌভাগ্যক্রমে শত শত পোশাক শ্রমিক প্রাণে বেঁচে যান কিন্তু তাদের বেশিরভাগকেই পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়।

রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ধ্বংসস্তূপ থেকে ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত এবং ১ হাজার ১১৭ জনকে মৃত উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরও ১৯ জন। সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ১৩৬ জনে। আহত হন ১ হাজার ৫২৪ জন। ২৯১টি মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করা ছাড়াই ঢাকার জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। পরে ১৫৭টি লাশের পরিচয় শনাক্ত সম্ভব হয়েছে। তবে এই দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের স্বজনেরা যেমন যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাননি, তেমনি যথাযথ সহায়তা না পাওয়ায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে অনেক শ্রমিক ফিরতে পারেননি স্বাভাবিক জীবনে। তাই হতাহতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও দোষীদের ফাঁসির দাবিতে প্রতিবছরই এই দিনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নানা কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন সংগঠন। 
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর নানা অভিযোগে বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ, রাজউকের করা ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন, নিহত একজন পোশাক শ্রমিকের স্ত্রীর করা খুনের মামলা এবং পুলিশের করা কয়েকটি মামলা। এসব মামলার মূল আসামি ভবন মালিক সোহেল রানা। ঘটনার পর পর ভবনটির মালিক সোহেল রানা পালিয়ে দেশত্যাগের চেষ্টা করেন। ঘটনার পাঁচদিন পর ২৯ এপ্রিল ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পথে সোহেল রানাকে যশোরের বেনাপোল থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এরপর থেকে রানা কারাগারেই আছেন। মামলা দায়েরের দুই বছরের বেশি সময় পর ২০১৫ সালের ১ জুন তদন্ত শেষে দুটি অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর।

এর একটিতে পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগে ভবন মালিক সোহেল রানা, তার বাবা-মা এবং তৎকালীন সাভার পৌরসভার মেয়র ও কমিশনারসহ ৪১ জনকে আাসমি করা হয়। আর ইমারত বিধি না মেনে রানা প্লাজা নির্মাণের অভিযোগে অপর অভিযোগপত্রে সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়। দুই অভিযোগপত্রে মোট আসামি ছিলেন ৪২ জন। এরমধ্যে সোহেল রানাসহ ১৭ জন দুটি মামলারই আসামি। আসামিদের মধ্যে তিনজন ইতোমধ্যে মারা গেছেন।
সোমবার সকাল থেকে রানা প্লাজার সামনে অবস্থিত অস্থায়ী বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান আহত-নিহতদের স্বজন ও শ্রমিক নেতারা। এ সময় তারা ক্ষতিপূরণ ও ভবন মালিকসহ দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে কর্মসূচি পালন করেন। তাদের দাবিগুলো হচ্ছে- সব দোষীদের পরিচয় জনগণের সামনে এনে ভবন মালিক সোহেল রানাসহ সবার সর্বোচ্চ শাস্তি, রানা প্লাজার নিহত শ্রমিকের প্রতিনিধি ৪০ লাখ পোশাক শ্রমিকের জন্য অবিলম্বে মজুরি বোর্ড ও ২৫ হাজার টাকা মজুরি, মজুরি বৃদ্ধির আগ পর্যন্ত ৬০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা প্রদান, ক্ষতিপূরণের আইন বদল করে এক জীবনের ক্ষতিপূরণ, আহত শ্রমিকদের দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসাভার ও প্রয়োজনীয় পুনর্বাসন, রানা প্লাজা এলাকা যথাযথ সংরক্ষণ ও স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি, সব শ্রমিকদের জন্য মালিক-সরকার ও বায়ারের উদ্যোগে জরুরি তহবিল গঠন এবং ২৪ এপ্রিল শোক ও নিরাপত্তা দিবস হিসেবে সব কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা।
রানা প্লাজায় আহত শ্রমিক বুলবুলি আক্তার বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসে আমি পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। নামমাত্র অনুদান ছাড়া আমি ক্ষতিপূরণ পাইনি। বিচারও পাইনি। আমাদের কোনো দাবিই পূরণ হয়নি। আমরা ক্ষতিপূরণ ও দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি চাই।’ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আক্তার বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর থেকেই আমরা বিভিন্ন দাবি তুলে আসছি। এই ১০ বছরে আমাদের দাবিগুলো পূরণ হলো না। ১০ বছর পরে এসেও আমরা একই দাবি জানাচ্ছি। গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি ১০ বছর হয়ে গেলেও এখনো নিহত শ্রমিক পরিবারের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন হয়নি। রানা প্লাজার নৃশংস হত্যাকা-ের বিচারও হয়নি। 
রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের এক জীবনের আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন ব্যবস্থা করা, রানা প্লাজা ধসের জন্য দায়ী সবার বিচারের ব্যবস্থা, দেশের শ্রম আইন সংস্কার করে শ্রমিকবান্ধব আইন গড়ে তোলা, দেশের সব শিল্প খাতে আহত শ্রমিকদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা ও সরকারি ভাতার ব্যবস্থার দাবি জানান তিনি। এর আগে বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর সময় চোখের জলে নিহতদের স্মৃতিচারণ করেন আহত শ্রমিক ও স্বজনরা। 
এদিকে সাভারে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ১০ বছর উপলক্ষে রাজধানীর জুরাইন কবরস্থানে দায়ীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্র্রন্ট, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফেডারেশন, শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরাম। সোমবার সকালে রানাপ্লাজা দুর্ঘটনায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তারা বলেন, এটা নিছক কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। এটা ছিল হত্যাকা- এবং তারা এই হত্যাকা-ের বিচার নিয়ে টালবাহানা করা হচ্ছে। এসব সংগঠনের নেতারা বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি এবং এই ঘটনার যারা আহত হয়েছেন তাদের খবরও এখন কেউ নেয় না যা অত্যন্ত কষ্টদায়ক।

তারা বলেন, যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যারা পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন তাদের ক্ষতিপূরণ না দিয়ে গার্মেন্টস মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। এ সময় বক্তারা শ্রম আইন সংশোধন করে আজীবন আয়ের মানদ-ে ক্ষতিপূরণেরও দাবি জানান। এ সময় তারা সারাকা, তাজরীন, সেজান জুস, সীমা অক্সিজেন কারখানায় হত্যাকা-ের বিচারও দাবি করেন। শ্রমিক নেতারা মনে করেন আগের ঘটনায় যথাযথ বিচার নিশ্চিত হলে রানা প্লাজায় এমন হত্যাকাণ্ড ঘটত না।

×