ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বাঙ্গালি নিধনে পাকিস্তানিদের বিশ্বাসঘাতকতার উপাখ্যান

সংবাদদাতা, সৈয়দপুর, নীলফামারী

প্রকাশিত: ১৪:২১, ২ ডিসেম্বর ২০২২

বাঙ্গালি নিধনে পাকিস্তানিদের বিশ্বাসঘাতকতার উপাখ্যান

নাম ফলক

পলাশীর প্রান্ত থেকে সৈয়দপুর। দুইশত চৌদ্দ বছর পরে স্থান, কাল ও পাত্র বদল হলেও বদলায়নি বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের অনুসারী এ জনপদের উর্দুভাষীরা। তারা ছলনা করে ১৯৭১ সালে এ জনপদের প্রায় ৮ হাজার নিরীহ বাংঙ্গালিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। প্রিয়জনদের হারানো সেই ক্ষতের যন্ত্রণা এখনও বিদগ্ধ  করছে এ সকল শহীদ পরিবারদের।    

মূলত বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার ও ফরাসি মিত্রদের সঙ্গে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পলাশী নামক স্থানে  ১৭৫৭ সালের জুন ২৩ তারিখে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে নবাবের বিশ্বস্ত সহচর মীর জাফর আলী খানের চক্রান্তে পরাজয় ঘটে। এতে ভারতবর্ষে ইংরেজদের শাসনের পথ রচিত হয়। 

পাকিস্তানি দোসররা ৩০ লাখ বাঙ্গালি হত্যা ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ঘটিয়ে মীর জাফরের পথে হাটলেও এ দেশ তারা পায়নি। তবে ৫১ বছর আগের সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা করতে গিয়ে এখনও আতঁকে ওঠেন শহীদ পরিবারের সদস্য ও প্রতক্ষ্যদর্শীরা।

জানা যায়, শুরুতেই এ শহরের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ হন মাহতাব বেগ। পরে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী সংগঠক ও বুদ্ধিজীবি ডা. জিকরুল হক, ডা. শামসুল হক, ডা: বদিউজ্জামান, তুলশীরাম আগারওয়ালা, ডা. ইয়াকুব আলী, আমিনুল হকসহ সকল বুদ্ধিজীবীকে এপ্রিল মাসে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায়। রংপুরের বালার খাল নামক স্থানে তাদেরকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। অভিভাবকহীন হয়ে যায় এ শহর। পাক সেনা ও তাদের দোসররা পরিকল্পিতভাবে চালায় বাঙ্গালী নিধন। অবরুদ্ধ হিন্দু ও মারোয়াড়িদের নিরাপদে ভারতে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে ট্রেনে উঠিয়ে গোলাহাট নামক স্থানে ৪৪৮ জন হত্যা করে। 

সেই ঘটনা থেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায় ২২ যুবক। তাদের মধ্যে বিনোদ আগারওয়াল, শ্যাম সুন্দর আগারওয়াল, তপন চন্দ্র দাস ও গোবিন্দ চন্দ্র দাস নামে চারজন বেচে আছেন। এই ৫১ বছর পর গত বৃহস্পতিবার দুপুরে শহীদ তুলশীরাম সড়কস্থ তাদের বাড়িতে দেখা যায়,  সকলে এখন অশীতিপর বৃদ্ধ। বার্ধ্যক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত। চলাফেরা করছেন কোন ভাবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের ওই ভয়াল দিনের কথা জানতে চাইলে স্মৃতি হাতরিয়ে তারা কেঁদে ওঠেন।

সকলেই বলেন, তারা বিশ্বঘাতকতা করেছে। এ শহরের বসবাসরত সব হিন্দু ও মারোয়াড়িকে মারার জন্য ডেকে নিয়ে যায়। শিশু থেকে বৃদ্ধ ও সকল বয়সী নারী-পুরুষকে কুপিয়ে হত্যা করে।

ক্ষোভের সঙ্গে গোবিন্দ দাস জানান, এ ঘটনা বলছি ৫১ বছর ধরে। এখন ক্লান্ত। পাকিস্তানিদের নির্মমতা পরবর্তী প্রজন্মদের জানা উচিত। তাহলে দেশের প্রতি ভালবাসা বাড়বে। ১৯৭০ সালে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাবে জয় লাভ করে। পাক শাসকেরা বঙ্গবন্ধুকে শাসনভার না দিয়ে সময় ক্ষেপন করেন। এরই প্রভাব পড়ে উর্দুভাষী এ জনপদে। 

তারা নানা অজুহাতে শুরু দাঙ্গা। পরে পাকিস্তানি প্রজাতন্ত্র দিবসে উর্দুভাষীরা পাকিস্তানি এবং বাঙ্গালিরা বাংলাদেশের পতাকা উত্তলন করায় দ্ব›দ্ব চরমে পৌঁছে। এ শহরে বসবাসকারী উর্দুভাষীদের নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। ২৩ মার্চ থেকে তারা শুরু করে হত্যাযজ্ঞ। ৬ জুন সেনাবাহিনীর সদস্যরা ক্যন্টনমেন্টে মেজর জাবেদের সাথে মিটিংয়ের কথা বলে ১১ জন হিন্দু মাড়োয়ারিকে কোয়াটার গার্ডে রাখা হয়।

শ্যাম সুন্দর আগারওয়াল জানান, সেখানে নির্মাণাধীন সৈয়দপুর বিমানবন্দরে কাজ করান। পরে ১২ জুন পাকসেনারা বলেন, আপনাদের ওপর মেজর সাহেব খুবই খুশি। তাই আপনাদের নিরাপদে ভারতে পৌঁছে দেয়া হবে। ওই দিন রাত ১০ টায় সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতে স্টেশনে নেয়া হয় বন্দীদের। পাকসেনাদের কর্মকর্তারা নির্দেশ দেন প্রতি পরিবারের একজন নিজ নিজ বাড়ি থেকে অন্যান্যদের স্টেশনে নিয়ে আসতে। তাদের ব্যাবস্থাপনায় দুইটি বড় গাড়িতে সবাইকে স্টেশনে এনে ট্রেনের সামনের দুটি কোচে ওঠানো হয়। 

পরে ওই ট্রেনে যুবতীদের আলাদা রাখা হয়। পরিবারের নারীদের না পেয়ে শুরু হয় স্বজনদের মাতম। রেললাইনের ধারে রক্তনদী, আর্ত্বনাদ আর চোখের পানিতে বাতাস ভারি হয় গোলাহাট নামের ওই স্থান। সকাল ৭ টা থেকে ৯ টার মধ্যে ৪৪৮ জন মানুষকে কুপিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়।  তবে পরিবারের কোন নারীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।   

তপন দাস জানান, আজ জাতীর জনক আজ বেচে থাকলে হয়ত শহিদ পরিবাররা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেত। খুনী খন্দকার মুশতাকের পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় জেনারেল জিয়াউর রহমান ইসলামি ভাবধারার বিলুপ্ত রাজনৈতিক দল, বাম ও মওলানা ভাসানীর অনুসারীদের নিয়ে প্রথমে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট ও পরে জাতীয়তাবাদী দল গঠন করে রাষ্ট্রপতি হন। তার শাসন আমলে শহিদ পরিবারের সদস্যদের কোন মূল্যায়ন হয়নি। 
এমনকি ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতসহ ৪ দলীয় জোট সরকার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। ওই সময় সংখ্যালঘুদের ওপর যে অমানবিক বর্বরতা ও নির্যাতন চালানো হয়। একই ভাবে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় পাকি জল্লাদরা প্রায় সাড়ে তিনশত বাঙ্গালীকে হত্যা করে। তারা শহরব্যাপী মাইকিং করে সকল রেলকর্মচারিদের কাজে যোগ দানের জন্য নির্দেশ জারি করেন। 

সেখানে অবাঙালী অধ্যক্ষ মতিন হাশমী, হব্বু বিহারী, জাহিদ ও রেলওয়ের অবাঙালী নরপিশাচরা কারখানার ফাউন্ড্রি শপের ১৮ শত সেন্টিগ্রেড ফারেনহাইট তাপমাত্রার ৩টি চুল্লী ও ফার্নেস চুল্লিতে নিক্ষেপ করে। কয়লা ও বৈদ্যুতিক বাতাস দ্বারা লোহা গলানো লাভায়  তাদের দেহের হাড়, মাংস ও রক্ত গলে পানি হয়ে বেরিয়ে আসে। এছাড়া কারখানার বিভিন্ন সপে বাঙ্গালী কর্মচারীদের হত্যা করা হয়। 

সৈয়দপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এর সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. একরামুল হক বলেন, এ শহরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রতিরোধ গড়া হয়নি। কারণ এখানে পাক সেনানিবাস ছিল। তবে বাঙ্গালীদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে হত্যাকান্ড ঘটয়েছে। এর বিচার হওয়া দরকার। 

শহীদ পরিবারের সন্তান ও সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মহসিনুল হক বলেন, এ শহরের পরতে পরতে বধ্যভুমি।  তাদের প্রানের বিসর্জন বৃথা হতে দিব না। হত্যাকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে যুদ্ধপোরাধের দায়ে বিচারের সরকারের কাছে আবেদন জানানো হবে।

এসআর

×