ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২১ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

অনেক সাধনার পর মোহামেডানের হাসি

শাকিল আহমেদ মিরাজ

প্রকাশিত: ০০:৩৮, ২১ মে ২০২৫

অনেক সাধনার পর মোহামেডানের হাসি

পেশাদার লিগের ইতিহাসে প্রথম শিরোপা জিতেছে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব।

দুই যুগ! হ্যাঁ, প্রায় দুই যুগ। দীর্ঘ ২৩ বছর পর অবশেষে বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ফিরে পেল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। সর্বশেষ ২০০৩ সালে শিরোপা জিতেছিল সাদা-কালো শিবির। আর ২০০৭ সালে পোশাদার ফুটবল (বিপিএল) নামকরণের পর মতিঝিলপাড়ার ঐতিহ্যবাহী এ ক্লাবটির এটি প্রথম শিরোপা।

দেড়যুগে প্রথম সাফল্যের স্বাদ তারা পেয়েছে মাঠের বাইরে থেকেই। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ঢাকা আবাহনীর ২-১ গোলের হারে তিন ম্যাচ আগেই চ্যাম্পিয়নশিপ নিশ্চিত হয়ে যায় মোহামেডানের। খেলা হচ্ছিল কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে। আবাহনী আর ফর্টিস এফসি মুখোমুখি। ম্যাচে ফর্টিসের কাছে হারছিল ঢাকা আবাহনী। একই সময়ে উৎসবের রং জমে উঠছিল ঢাকার মিতিঝিলে মোহামেডান ক্লাব চত্বরে।

মোহামেডান ফুটবলারদের সঙ্গে শতাধিক সমর্থক ক্লাবের জার্সি পরে, পতাকা নিয়ে বিজয়ের স্লোগান দিচ্ছিল। সাদা-কালোদের আঙ্গিনা বিজয়ের রঙে রঙিন করে তুলছিল। ২০০৭ সালে পেশাদার ফুটবল লিগ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৮টি বছর কেটে গেছে। এই ১৮ বছরে ১৮টি শিরোপার নিষ্পত্তি হলো; কিন্তু একবারও শিরোপা জিততে পারেনি মোহামেডান। অবশেষে এল কাক্সিক্ষত সেই ক্ষণ; জয়ের পর মতিঝিলপাড়ায় ক্লাবটির প্রাঙ্গণেও উল্লাসে ফেটে পড়ল ভক্ত-সমর্থক ও কর্মকর্তারা। 
২০০৭ সালে পেশাদার লিগ নামকরণের পর এই শিরোপার হাহাকার ছিল মোহামেডানের। অবশেষে সে অপেক্ষার পালা ফুরাল তাদের। শীর্ষ লিগ হিসেবে ২০০২ সালের পর প্রথম এই ট্রফির স্বাদ পেল সাদা-কালো জার্সিধারীরা। গত মৌসুমেও লিগ জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়েছিল মোহামেডান; কিন্তু পূর্ণতা দিতে পারেনি।

টেবিলে কিংসের পরে অর্থাৎ দ্বিতীয় স্থানে থেকে তারা শেষ করেছিল আসর। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ভালোবাসার আরেক নাম মোহামেডান স্পোর্টি ক্লাব লিমিটেড। কোটি কোটি ভক্ত-সমর্থকের ভালোবাসার ক্লাব এটি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ঘরোয়া ফুটবলের প্রধান আসর পেশাদার লিগে সাফল্যের হাসি হাসতে পারছিল না বিখ্যাত সাদা-কালো জার্সিধারীরা। অন্য আসরে কিছুটা সাফল্য এলেও লিগ যেন সোনার হরিণে পরিণত হয়। সেই আক্ষেপটা এবারের ২০২৪-২৫ মৌসুমে ঘুচিয়েছে দর্শকনন্দিত মোহামেডান।

অবশেষে ধরা দিয়েছে কাক্সিক্ষত ট্রফি। লিগে নিজেদের তিন ম্যাচ বাকি থাকতেই অন্যদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে মতিঝিলপাড়ার ক্লাবটি।  চাতক পক্ষীর মতো অপেক্ষা করে দীর্ঘদিনের সাধনা সফল হওয়ার পর মোহামেডানের তাঁবুতে চলছে বাঁধভাঙা আনন্দ-উৎসব। গত শনিবার শিরোপা নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই ক্লাবটিতে যেন ঈদের খুশি বিরাজ করছে। খেলোয়াড়, কর্মকর্তা, কোচ, ভক্ত-সমর্থকদের আনাগোনা বেড়েছে মতিঝিলের ক্লাব প্রাঙ্গণে। সবার মুখে তৃপ্তির হাসি।

ক্লাব এবং সমর্থকরা এখন কিভাবে বিরাট এই সাফল্যকে উদ্যাপন করা যায় সেই পরিকল্পনায় ব্যস্ত। মোহামেডানের বেশ কয়েকটি সমর্থক দল রয়েছে। তারা সবাই এই সাফল্যে আনন্দে আত্মহারা। মোহামেডানের ব্যতিক্রমধর্মী সমর্থক দল ‘মহাপাগল’ হাতে নিয়েছে বিরাট আনন্দ আয়োজন। সমর্থক দলের প্রধান কর্ণধার টি ইসলাম তারিক জানিয়েছেন, বর্ণাঢ্য আয়োজনে চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান দলকে সংবর্ধনা দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন তারা।   
২০০২ সালের পর ঘরোয়া ফুটবলে এটি মোহামেডানের প্রথম শিরোপা। আর ২০০৭ সালে শুরু হওয়া পেশাদার লিগেও এটা সাদা-কালোদের প্রথম সাফল্য। মোহামেডানের এমন সাফল্যের প্রধান দুই কারিগর কোচ আলফাজ আহমেদ ও অধিনায়ক সুলেমান দিয়াবাতে। মাঠের বাইরে থেকে মোহামেডানের ঘরের ছেলে আলফাজ দলকে গেঁথেছেন এক সুতোয়।

আর মাঠে নিজে সামনে থেকে পারফর্ম করে নেতৃত্ব দিয়েছেন মালির তারকা দিয়াবাতে। প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই মোহামেডানকে একাই টেনে নিয়ে গেছেন তিনি। তিনটি ভিন্ন ভূমিকায় মোহামেডানের হয়ে লিগ জয়ের অনন্য রেকর্ড গড়েছেন আলফাজ। ১৯৯৬ সালে খেলোয়াড় হিসেবে, ১৯৯৯ সালে অধিনায়ক হিসেবে ও ২০০৫ সালে আলফাজ জাতীয় লিগ জেতেন অধিনায়ক হিসেবে। এবার ২০২৫ সালে কোচ হিসেবে এনে দিয়েছেন আরাধ্য পেশাদার লিগ শিরোপা।
২০১৩ সালে মোহামেডানের জার্সিতেই পেশাদার ফুটবলের ইতি টানেন আলফাজ। ২০২০ সালে ক্লাবটিতে সহকারী কোচ হিসেবে যোগ দেন। তখন প্রধান কোচ ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার শন লেন। লেনের পর দায়িত্ব পান শফিকুল ইসলাম মানিক। মোহামেডানের সময়টা তখন ভালো যাচ্ছিল না। ২০২৩ সালের লিগের দ্বিতীয় পর্বে সহকারী থেকে প্রধান কোচের দায়িত্ব পান আলফাজ। ওই মৌসুমেই ১৪ বছর পর জেতান ফেডারেশন কাপ।

২০২২-২৩ মৌসুমে সেই শিরোপা জয়ের পর ২০২৩-২৪ মৌসুমে বিপিএল ফুটবল, ফেডারেশন কাপ ও স্বাধীনতা কাপে দলকে রানার্সআপ করান। চলতি মৌসুমে চ্যালেঞ্জ কাপে হয় রানার্সআপ। অবশেষে প্রাণের ক্লাবকে জিতিয়েছেন পেশাদার লিগের শিরোপা। সঙ্গত কারণেই উল্লসিত আলফাজ। তিনি বলেন, মোহামেডানের যে ঐতিহ্য সেটা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কোচ হিসেবে কাজ শুরু করি। কিছুটা হলেও ফিরিয়ে আনতে পেরে গর্ব হচ্ছে।

কারণ এই ক্লাব থেকেই আমার পথচলা শুরু। আমার পরিচিতি, ভালোবাসা সবকিছুই মোহামেডানময়। মোহামেডানের সাফল্যের অন্যতম কারিগর অধিনায়ক সুলেমান দিয়াবাতে। গত ছয় বছর তিনি সাদা-কালো দলে খেলছেন। ধারাবাহিকভাবে তিনি দুর্দান্ত পারফরম্যান্স প্রদর্শন করে চলেছেন।

অবশেষে ক্লাবকে কাক্সিক্ষত ট্রফি এনে দিতে পেরে তৃপ্ত তিনিও। দিয়াবাতে বলেন, অনেক ক্লাব থেকে আমার অফার ছিল। আমি যাইনি। কারণ মোহামেডানকে চ্যাম্পিয়ন করতে চেয়েছি। আল্লাহর রহমতে মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এটাই আমার তৃপ্তি।
২০২১ সাল থেকে মোহামেডানের ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর। ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক পরিচালকই চার বছরের বেশি সময় মোহামেডানের ফুটবল দল দেখাশোনা করছেন। সাফল্যের পর মোহামেডান ক্লাবের অন্যতম পরিচালক ও ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, এটা মোহামেডান ক্লাবের জন্য খুব খুশির দিন। খেলোয়াড়, কোচিং স্টাফ, টেকনিক্যাল কমিটি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ সাফল্য ধরা দিয়েছে।

লিগ শিরোপা জেতায় মোহামেডান এখন এএফসি কাপে খেলবে, ‘মোহামেডান এএফসি কাপে খেলবে, এটা অনেক বড় গর্বের বিষয়। আমরা চাই মোহামেডান সবসময় উপরের দিকে যাবে।’ বলেন আলফাজ। এএফসির শর্ত অনুযায়ী একটা ক্লাবের কোচকে উয়েফা প্রো-লাইসেন্সধারী হতে হয়।  এ প্রসঙ্গে মোহামেডান কোচের বক্তব্য, ‘যখন যাঁকে দরকার, ক্লাব অবশ্যই তাঁকে  নেবে। এখানে তো আমার কথায় চলবে না।

আফসোস লাগারও কিছুই নেই। এটা আসলে ব্যক্তির চেয়ে দল বড়। দল যেখানে যেটা ভালো হবে, সেটাই করবে। এটাই স্বাভাবিক।’ তাহলে আলফাজকে ছাড়া এএফসি কাপে খেলবে মোহামেডান? ‘আমার পরেরটাই প্রো-লাইসেন্স। বাংলাদেশে যদি পরে হয়, তাহলে করব। আর আগামী এএফসি কাপের আগে এটা করা সম্ভব নয়। আমি আগেও বলেছি ব্যক্তির চেয়ে দল বড়। আপনাকে দলের বিষয়ই দেখতে হবে আগে।’

এবার কখনও মনে হয়েছে যে চ্যাম্পিয়ন হতে পারবেন?,‘আবাহনীর সঙ্গে ১০ জন নিয়ে যখন ম্যাচটি ড্র করেছি, তখনই মনে হয়েছে এবার আমরা পারব। কারণ আমরা দুই লেগে বসুন্ধরা কিংসকে হারিয়েছি। আবাহনীর বিপক্ষে দুই লেগের একটিতে জিতেছি, আরেকটিতে ড্র করেছি। এরপর ফর্টিসের বিপক্ষে পিছিয়ে পড়েও ড্র করাটা আমাদের জন্য ইতিবাচক ছিল।’

গতবার রানার্সআপ মোহামেডান এবার মৌসুমের শুরু থেকেই শিরোপার রেসে ছিল। ‘হ্যাঁ, গত বছর তিনটি টুর্নামেন্টের ফাইনালে আমরা খেলি এবং সবগুলোতে হেরে যাই। তবে চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও তখন থেকে একটা আত্মবিশ্বাস ছিল যে আমরাও চ্যাম্পিয়ন হতে পারব। ফাইনাল স্টেজে যখন যেতে পেরেছি, তখন শিরোপাও জিততে পারব; এই মানসিকতা ছিল আমাদের মধ্যে। 
এই টার্গেট নিয়ে এগিয়েছি। আমরা পুরো দলকে এক করেছি। বলতে পারেন সবার ঐক্যবদ্ধ থাকার ফল এটি। খেলোয়াড়, অধিনায়ক এবং কোচ হিসেবে মোহামেডানের হয়ে শিরোপা জিতেছি। আমি কোনোটাকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করতে চাচ্ছি না। একজন প্লেয়ার হিসেবে চ্যাম্পিয়নশিপটা বেশি আনন্দের। আমার কাছে তিনটিই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটা যেহেতু দীর্ঘদিন পর, অনেক অপেক্ষার পর এসেছে; এটাই বেশি আনন্দের।’

×