
সার্টিফাইড জিম ট্রেনার, ভারোত্তোলক প্রশিক্ষক ও ফিটনেস অ্যান্ড হেলথ কাউন্সিলর আতিকুর রহমান
ধাতব গুহা। মানে মেটাল কেভ। ঢাকার মোহাম্মদপুরে অবস্থিত দোতলাবিশিষ্ট একটি জিমনেশিয়ামের নাম। এই জিমের সবকিছুই লোহালক্কড়। এজন্যই জিমের এমন নামকরণ। যিনি এই ‘ধাতব গুহা’র প্রতিষ্ঠাতা-মালিক, তিনি আতিকুর রহমান। বয়স ৪৮ বছর। দেশের বাড়ি বরিশাল। তবে জন্ম ঢাকার মোহাম্মদপুরে। তারা দুই ভাই, দুই বোন। তিনি দ্বিতীয়। ভাইবোনরা সবাই দেশের বাইরে প্রতিষ্ঠিত। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি অপরিসীম আগ্রহ ছিল আতিকুরের। ইন্টারস্কুলে ফুটবল খেলেছেন।
১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হলে ক্রিকেটের দিকে ঝুঁকে পড়েন অতিমাত্রায়। এতে মা-বাবা ক্ষুব্ধ হন। লেখাপড়ার দিকে মনোযোগ দিতে বলেন। পেস বোলার ছিলেন আতিকুর। ইনজুরিতে পড়লেন। ফলে ক্রিকেট ক্যারিয়ারটা দীর্ঘায়িত হলো না। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা গ্রাস করল তাকে। তখনই তার জীবনের মোড় ঘুরে গেল। বলা যায় ভবিষ্যতের বীজ বপন হলো।
এলাকার এক বড় ভাই (মেহেদী) আতিকুরকে বললেন জিমে যেতে। মোহাম্মদপুরে ব্যক্তি মালিকানার জিম সেটাই প্রথম। কয়েকদিন যাওয়ার পর বেশ ভালো লেগে গেল আতিকুরের। জেনিটিক্যালি তার ফিজিক্যাল গ্রোথ ভালো। তাই জিমে অন্যদের চেয়ে অনেক আগেই তার শারীরিক উন্নতি হলো।
তখনই ঘটে পারিবারিক বিপর্যয়। হার্ট এ্যাটাক করে মারা গেলেন আতিকুরের বাবা আবদুল খালেক! সাক্ষাৎকারে আতিকুর বলেন, ‘পারিপার্শি^ক অবস্থাই আমাকে বাধ্য করল এ ধরনের জিম করার মতো শৌখিন কাজ থেকে বিরত থাকতে। আমি পরিবারের বড় ছেলে। ফলে এগুলো বাদ দিয়ে নেমে পড়লাম চাকরির খোঁজে। মধ্যবিত্ত পরিবারে যা হয়।
জুনিয়র মার্চেন্টডাইজার হিসেবে বনানীতে একটা বায়িং হাউজে জয়েন জয়েন আট বছরের মতো এটা রান করলাম। আর্থিকভাবে সচ্ছলতা এলো। বাবার রেখে যাওয়া টিনশেড বাড়িটা ছয়তলা করলাম। তারপর উপলব্ধি করলাম এই পেশায় দিনরাত কাজ, দুশ্চিন্তা, নানা ঝামেলা, চাপ। স্ত্রী-বাচ্চাদের সময় দিতে পারি না। শরীরও বেশ খারাপ হয়ে গেল।
মেডিক্যাল চেকআপে ধরা পড়ল কোলেস্টরেল অনেক বেশি! এমনটা চললে হার্ট এ্যাটাক হবে। ডাক্তার যখন শুনলেন চাকরির কারণে আমার কোনো শারীরিক এক্টিভিটিস নেই, তখন অবাক হলেন। বললেন, এভাবে চললে বেশিদিন বাঁচবো না!’
ততদিনে আতিকুর এক ছেলে, এক মেয়ের বাবা (২০০৫ সালে বিয়ে করেন)। তাদের জন্য বেঁচে থাকার তাগিদে পেশা পরিবর্তন করার কথা ভাবলেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ৪০ বছর বয়সে মানুষ সাধারণত যা করে না, সেটাই করলেন আতিকুর। কিন্তু মা দেলোয়ারা বেগম বাঁধ সাধলেন। তবে নিজের মধ্যে আত্মবিশ^াস ছিল। যেহেতু খেলাধুলাটা নিজের প্রাণের ভেতর থেকে আসে, জিমটাও খেলাধুলার অংশ মনে হলো।
কাজেই আতিকুর ঠিক করলেন তিনি জিমের ব্যবসাই করবেন। এটাই তাকে বেশি টানলো, ‘আবারও রিস্ক নিলাম। একটা প্লট বিক্রি করলাম। কিছু জমানো টাকা ছিল। এগুলো দিয়ে জিম ব্যবসা শুরু করলাম ২০১৬ সালে।’ বায়িং হাউজের ক্যারিয়ারে যে রকম আয় করতেন, এখন জিম ক্যারিয়ারে সে পরিমাণ আয় না হলেও তা সংসার চালানোর মতো যথেষ্ট আতিকুরের জন্য। তাছাড়া সাপোর্ট হিসেবে বাড়িভাড়াও পান। সবচেয়ে বড় ব্যাপারÑআগের সেই মানসিক চাপ ও শারীরিক অসুস্থতা থেকে মুক্তি তো পাওয়া গেছে!
এ ব্যাপারে আতিকুরকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ-সমর্থন জুগিয়েছেন তার স্ত্রী নুসরাত জাহান। তিনি মেটাল কেভ জিমে ট্রেনার হিসেবে মেয়েদের জিম করান। নিজেও জিম করেন। তার বাচ্চারাও তাই। আতিকুরের ছেলে রাফসান বর্ষণ। বয়স ১৬। মেয়ে রোজা মারিয়া বাবুই। বয়স ১১। জিম ব্যবসার পাশাপাশি নিজেও জিমে ব্যায়াম করে আতিকুর এখন সম্পূর্ণ সুস্থ, সবল, সুঠামদেহী।
আমূল পাল্টে ফেলেছেন খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাপনের ধরন। জিম ব্যবসার পাশাপাশি মানুষদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য অনলাইন ও ফিজিক্যালি পরামর্শও দিয়ে থাকেন তিনি। এর আগে প্রচুর পড়াশোনার পাশাপাশি রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে একাডেমিক সার্টিফিকেটও অর্জন করেছেন তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ন্যাশনাল কাউন্সিল অব স্ট্রেংথ অ্যান্ড ফিটনেস থেকে, ২০১৮ সালে। তিনি এখন সার্টিফায়েড পার্সোনাল ট্রেনার ও পাওয়ারলিফটিং কোচ। এছাড়া পাওয়ারলিফটিং রেফারিং কোর্সও করেছেন।
সে বছরেই হঠাৎ একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল আতিকুরের। জিম রিলেটেড পাওয়ার ওয়েটফিটিং কম্পিটিশন হবে। পাওয়ার ওয়েটফিটিং হচ্ছে অতিরিক্ত ওজন উত্তোলন করা। যুক্তরাষ্ট্রের জো ওয়েডান এবং রনি কোলম্যানদের হাত ধরে খেলাটার উৎপত্তি। সেখান থেকে ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ারলিফটিং ফেডারেশন গড়ে ওঠে ১৯৬৪ সালে। বাংলাদেশ সেটার একটা শাখা (বাংলাদেশ পাওয়ারলিফটিং অ্যাসোসিয়েশন, তখন অবশ্য সেটা গঠিত হয়নি, ব্যক্তি উদ্যোগে চলছিল কার্যক্রম)।
তারাই বিজ্ঞাপনটা দেয়, ‘তখন আমার সঙ্গে আদিব জিহান নামের ২০-২২ বছর বয়সী একটা ছেলে জিম করতো। তাকে বললাম কম্পিটিশনে নাম দাও, আমি তোমার কোচ। ৬৬ কেজি ওজন শ্রেণিতে অংশ নিয়ে সে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল। তারপরের বছর নিজেই খেললাম। কিন্তু আমার বয়সের কোনো প্রতিযোগী না থাকায় মাস্টার্স ক্যাটাগরিতে না খেলে রেগুলার ক্যাটাগরিতে অংশ নিলাম, এরপর মাস্টার্স ক্যাটাগরিতে টানা তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছি (২০২২-২৪)। ২৪৫ কেজি তুলে রেকর্ডও গড়েছি।
এরপর আয়োজকরা আমাকে তাদের সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দিল। আমিও সাড়া দিলাম। আমরা গঠন করলাম বাংলাদেশ পাওয়ারলিফটিং অ্যাসোসিয়েশন। আমি ডেপুটি জেনারেল সেক্রেটারি। আমরা এশিয়া কাপে অংশ নিয়েছি। সেখানে একটা গোল্ড মেডেল অর্জন করেছি জুনিয়র ক্যাটাগরিতে। প্রতি বছর স্টুডেন্ট পাওয়ারলিফটিং চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেয় আমাদের অনেক ছেলে। তারা জাপান, মালয়েশিয়া, আমিরাতে গিয়ে খেলেছে। কিছুদিন পর মাস্টার্স ৮৩ কেজিতে অংশ নিতে তুরস্কে যাব।’
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আতিকুরের ভাষ্য, ‘ব্যক্তিগত লক্ষ্য পাওয়ারলিফটিংয়ে আন্তর্জাতিক পদক অর্জন। আর সাগরেদদেরও আন্তর্জাতিক পদক অর্জনে সহায়তা করা। এ পর্যন্ত দেশে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ হয়েছে ছয়-সাতবার। সবচেয়ে বেশি পদক জিতেছে আমার মেটাল কেভের স্টুডেন্টরা। আমরা বেস্ট জিম অ্যাওয়ার্ডও জিতেছি। মেটাল ওয়ার নামে একটা টুর্নামেন্ট প্রতিবছরই আমরা আয়োজন করে থাকি। বিজয়ীদের মেডেল ও সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। আর অ্যাসোসিয়েশন চেষ্টা করে দেশে প্রতিবছর অন্তত চারটা কম্পিটিশন আয়োজন করতে।’