ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

গুনগুন

শুক্লা পঞ্চমী

প্রকাশিত: ০১:০৭, ২১ এপ্রিল ২০২৩

গুনগুন

বিপ্লবীর চিন্তা বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ

‘কেউ আসবে নাকি? না মানে, বলছিলাম ষাটতম জন্মদিন একাই পালন করবেন?’ ‘কি আর করা। এই আকালের দিনে কাকে পাব। মহাদেবটা চলে গেল। রবিনটাও গেল কিছুদিন আগে। শুনলাম ফুয়াদেরও নাকি ফুরিয়ে আসছে। যমে মানুষে টানাটানি চলছে।’
‘বাব্বা, বিপ্লবীর আবার যম বিশ্বাসও আছে দেখছি! 
‘ও সরি, আপনি তো শুধুই বিপ্লবী নন কবিও বটে। আচ্ছা বিপ্লবীদের কি এমনটিই হতে হয়?’
‘কেমনটি?’
‘এই ধরেন ভূত প্রেত যম কোনো কিছুকেই বিশ্বাস না করা?’ 
‘বিপ্লবীর চিন্তা বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ।’ 
‘যম বিশ্বাস করলেন যে?’
‘যম বিশ্বাস অবিশ্বাসের কিছু নেই। বাস্তব। চির-সত্য। দম ফুরাইলেই ঠুস জাতীয়।’
‘বাহ! তার মানে এটাও বিশ্বাস করেন যে যম একজন অশরীরী ব্যক্তি। মৃত্যুর সময় আপনার দেহ থেকে আত্মা খুলে নিয়ে যাবে?’
‘অনেক কিছুই তো ঘটে যা বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার বাইরে’ 
ম্যাট্রিক্স দেখেছো? থ্রিলার মুভি। বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনীনির্ভর মুভি। যেখানে ডিস্টোফিয়ান ফিউচার দেখানো হয়।’
‘ডিস্টোফিয়ান ফিউচার কি?’
‘ডেস্টোফিয়ান হলো ভবিষ্যতের কোনো এক সময় যখন পৃথিবীতে জীবন ধারণ কঠিন হয়ে পড়বে। বেঁচে থাকার মৌলিক উপাদানগুলোর উৎপাদন কমে যাবে। প্রাকৃতিক সম্পদগুলো ফুরিয়ে আসতে থাকবে। মানুষ উন্নতি করতে করতে এমন একপর্যায়ে পৌঁছে যাবে, তখন রোবটরা প্রায় মানুষের সমান বুদ্ধিমত্তা অর্জন করে ফেলবে। তখন মেশিনরা দুর্যোগ বুঝতে পারবে। বেঁচে থাকার জন্য তারা মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে এবং তারাই জয়ী হবে।’
‘আচ্ছা। ইন্টারেস্টিং!
‘কাহিনীর মূল ভাব এ রকমই।
প্রচ- চ্যালেঞ্জ। যমে মানুষে টানাটানি।’
‘শিরশির করে উঠল গা। মৃত্যু সম্পর্কে যথেষ্ট পড়াশোনা আছে আপনার। একদিন জমিয়ে শুনতে চাই। দেখা হচ্ছে কবে?’ 
‘যখন যেদিন যেভাবে চাইবে ?’
‘সামনাসামনি কথা শোনার লোভ সামলাতে পারলাম না।’ 
‘হুম, যদি ঘোর কেটে যায়?’
‘তাহলে রোবটের সাহায্য নেব। আফটার অল ভবিষ্যতের ফাইটার। আগে থেকেই একটা পরীক্ষা হয়ে যাক। আর দেখা হলে শর্ত মনে আছে তো?’ 
‘হা হা হা।’
‘আজ রাতের পরিকল্পনা কি’ 
‘দেবী দেখব।’ 
‘হাওয়া দেখেছেন?’
‘দেখিনি’
‘কেন?’
‘হলে শুয়ে শুয়ে মুভি দেখার সিস্টেম নেই তাই।’ 
অলস
‘ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?’
‘আপাতত রিলাক্স।’
‘আচ্ছা আপনার পরিবারের কথা বলেন না কখনো, কেন?’
‘আমার পরিবার তোমার কোনো কাজে আসবে না তাই। 
‘এই যে এতক্ষণ চ্যাট করছেন অস্বস্তি লাগছে না? এত বকরবকর করলাম।’
‘না, উপভোগ করছি’ 
‘জানতে ইচ্ছে করে না আমি দেখতে কেমন’
‘না’ 
‘তার মানে আমার সম্পর্কে আপনার কোনো ইন্টারেস্ট নেই?’ 
‘কে বলল নেই।’
‘এই যে বললেন’
‘হা হা হা’ 
‘হাসছেন, ফোন রাখলাম। আর কথা বলব না।’
ফোন রেখে দেয় গুনগুন। তার এই পাগলামিগুলো ভীষণ উপভোগ করে জহির। এত ম্যাচিউরড। জহিরের সঙ্গে আজ পর্যন্ত দেখা হয়নি। অথচ কত সাবলীল। ভীষণ অস্থির লাগে জহিরের। পাগলামি কি তার ভেতরেও কম? ষাট বছর বয়সে এসে নতুন করে প্রেমালাপ। রীতিমতো থ্রিল।
আনিস বলছিল যুগটাই ভার্চুয়াল প্রেমের। বয়স ম্যাটার করে না। হিসাব কষলে দেখা যায় নব্বই শতাংশ মানুষ ভার্চুয়াল প্রেম করে। ভবিষ্যতে এর সংখ্যা এক শ ছাড়াবে। মন্দ বলেনি আনিস। যা দিনকাল পড়েছে। এত সময় কোথায়? আফসোস হয়। কিসের আফসোস? যখন সময়ের দরকার ছিল তখন মেলেনি। আর এখন অফুরন্ত সময় অথচ খরচের জায়গা নেই। আপন মনেই বেরিয়ে আসে কথাগুলো। ‘কে বলে নেই। এই যে মেয়েটি। গুনগুন। আমাকে উজাড় করে দিচ্ছে। ষাট বছর বয়সে এটা কম কি? মন্দ বলেনি আনিস। যা দিনকাল পড়েছে। এত সময় কোথায়? আফসোস হয়। 
কিসের আফসোস? যখন সময়ের দরকার ছিল তখন মেলেনি। আর এখন অফুরন্ত সময় অথচ খরচের জায়গা নেই। আপন মনেই বেরিয়ে আসে কথাগুলো।
‘কে বলে নেই। এই যে মেয়েটি। গুনগুন। আমাকে উজাড় করে দিচ্ছে। ষাট বছর বয়সে এটা কম কি?
হা হা হা করে হাসে জহির। নিজের সঙ্গে কথোপকথন। তর্কা-তর্কিতে হার জিত নেই। তবুও কোথায় যেন একটা কাঁটার মতো বিঁধে। রবীন্দ্রনাথের সেই গানের মতোÑ কেন মিছে এ কুয়াশা।
আবোলতাবোল ভেবে ভেবে গা এলিয়ে দেয় বিছানায়। অন্ধকার ঘর। গুনগুনের সঙ্গে চ্যাটিং করার সময় কখনো আলো জ্বালায় না। জহিরের আবিষ্কারÑ অন্ধকারের একটা শক্তি আছে। দূরের মানুষকেও কাছে এনে দেয়।
গুনগুন তার পাশে এসে বসে। মাথায় হাত বুলায়। তার পিঠের ওপর শুয়ে আল্লাদ করে কথা বলে। তার নামের মতোই গুনগুন করে গায়Ñ ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে।
ছটফট করে জহির। কল্পনার গুনগুন যেন সত্যি হয়ে ফিরে এলো। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করে। ঘামতে থাকে জহির। চোখের সামনে ভাসে ডেস্টোফিয়ান ফিউচার। এক ঝাঁক রোবট এগিয়ে আসছে তার দিকে। মাথার পেছনে কম্পিউটার ক্যাবল। এক্ষুনি কানেক্টেড হয়ে ধ্বংস করে দেবে তাকে। লাফ দিয়ে উঠে বসে। মাথার উপর স্থির হয়ে আছে ফ্যান। দরদর করে ঘামছে। ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে। জেনারেটরের তেল পোড়া গন্ধ লাগে। ফোন হাতে নিয়ে দেখে রাত দুটো। আননোন নাম্বার থেকে অনেকগুলো কল এসেছে। গুনগুনের ম্যাসেজ। এত ঘুমিয়েছে!
স্ক্রল করে গুনগুনের লেখাগুলো পড়ে জহির।
‘আমি বাসা থেকে বের হয়ে গেছি। আর ফিরব না। কালই আাপনার সঙ্গে দেখা হবে। কথা ছিল যেদিন দেখা হবে সেদিন দুজন-দুজনকে গ্রহণ করব। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েই বেরিয়েছি। ঠিকানা জানা ছিল না। না হলে আপনার এখানেই উঠতাম। কাল কথা হবে। দুটো দিন এক সঙ্গেই হোক। কি বলেন? জন্মদিন আর হি হি হি। শুভ রাত।
জহির ম্যাসেজটা বারবার পড়ছে। এত রাতে, অল্প সময়ের মধ্যে এমন কি ঘটে গেল যে, গুনগুন বাসা থেকে বের হয়ে গেল! মিলছে না কিছুতেই। ফোন দেবে গুনগুনকে নাকি ম্যাসেজ?। এত রাতে ফোন দেওয়াটা উচিত হবে না। জহিরের অস্থিরতা আরও বেড়ে গেল। কারেন্ট আসার নাম গন্ধ নেই। চারদিকে জেনারেটরের শব্দ, মাথার ভেতরটা ঝিমঝিম করছে।
ঠক ঠক শব্দ হয় দরজায়। কে এলো এত রাতে? রাতের শব্দ সহজেই চিহ্নিত করা যায় না। নিবিড় হয়ে শোনে। নাহ্, তার ঘরেই তো। বুঝতে না বুঝতেই আরও দুই তিন বার দুম দুম শব্দ। উঠে গিয়ে দরজা খুলতে দশ কদম। হঠাৎ অসাড় হয়ে আসছে হাত পা। দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরটা। চোখে ভাসছে গুনগুনের ম্যাসেজ। চলে আসেনি তো? ভয় আর উত্তেজনার মিশেল অনুভূতি জহিরের। মনে মনে সাহস নেয়, ভয়ের কি আছে। আসতেই পারে গুনগুন। এমনই তো হওয়ার কথা ছিল। বেলের শব্দ। কারেন্ট এসেছে। একটু স্বস্তি লাগছে জহিরের। খালি গা। টি-শার্টটা নেবে কিন্তু চোখ রাখতে পারছে না। পিট পিট করে তাকাচ্ছে। লোকটির তর সইছে না। এত রাতে কে ঢুকতে দিল তাদের? সময় জ্ঞান নেই। মধ্য রাতে কারও বাড়িতে কেউ আসে? গুনগুন আসলে কি করবে? জটিল সব প্রশ্ন নিয়ে দরজা খোলে জহির। ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। মুখ ফুটে অস্পষ্ট স্বরে বলে।
‘তুমি?’
‘বিশ্বাস হচ্ছে না?’
‘বিশ্বাস করতে চাচ্ছি না’
‘বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলব?’ ভেতরে যেতে বলবে না?
‘না, বলব না
‘কেন?’
‘কেন’র উত্তর জানা নেই’
‘দরজার মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে ভেতরের রাস্তা অটকিয়ে রেখেছে জহির। বিরক্তি নিয়ে গম্ভীর হয়ে বলেÑ
‘চলে যাও’
‘আসতেই দেবে না?’
‘না’
‘কিন্তু আমার যে আসতে হবে’
‘এত রাতে আমার ঘরে কোনো নারীকে অ্যালাও করি না’
‘ও আচ্ছা। হাসে শান্তা।’
‘জোর করছো?’
‘না, মিনতি করছি’
‘উপকার করার মতো আমার কাছে কিছু নেই শান্তা।’
‘তোমার কাছে টাকা টাকা চাইতে আসিনি।’
অনেক কাকুতি মিনতি’র পর মন গলে জহিরের। ভেতরে আসতে দেয়। তিনটি রুমের একটি অগোছালো ফ্ল্যাট। শান্তা ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে।
‘কি ভাবছ? ব্যাচেলর লাইফ। এমনটিই হয়।’
‘মানিয়ে নিতে শিখেছো তাহলে। সেই ফুলকো বাবুটি আর নেই।
‘প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাওয়া নেই। দাঁড়িয়ে কেন বসো, এসেই যখন পড়েছো।’
‘বসবো, চাইলে ঘুমাবো।’
‘একটুও বদলাওনি তুমি।’
‘বদলেছি। মেদ জমেছে।’
‘ঠিকানা পেলে কোথায়?’
‘ঠিকানা পাওয়া কি খুব কঠিন ? তোমার পুরনো অফিসে গিয়েছিলাম। তোমার সব খবর রাখি।’
‘যেমন?’
‘এই তোমার দিনকাল কেমন চলছে, কোথায় যাচ্ছো, কার সঙ্গে প্রেম করছো।’
‘প্রেম!’
‘হ্যাঁ প্রেম।
‘আচ্ছা তোমার উদ্দেশ্যটা কি বলতো? গোয়েন্দাগিরি করছো যে।’
‘মাঝে মাঝে নজরদারিতে রাখতে হয়।’
‘এতে লাভ?’
‘তুমি ভালো করেই জানো আমি লাভের বোঝা বইনা।’
‘তাহলে কেন এসেছো আমার কাছে? সব তো চুকে বুকে গেছে সেই কবে।’
‘চুকিয়ে দিলেই কি সব মিটে যায়? মূল্য দিতে হয় না।’
‘দেখ শান্তা তুমি খুব রহস্য করছো। ভণিতা ছেড়ে আসল কথা বলে ফেল। গভীর রাতে অযথা বাক্যব্যায় ভালো লাগছে না।’
‘গুনগুনের সঙ্গে প্রেমের খেলা বন্ধ কর।’
‘তার মানে?’
‘মানে খুব সহজ, অসম প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো। গুনগুন একটা বাচ্চা মেয়ে। তার বয়স মাত্র চব্বিশ।’
‘চব্বিশ বছরের মেয়ে বাচ্চা? গুনগুন অনেক ম্যাচিউরড। বয়সের ধার ধারে না। জেনে শুনেই সে আমার সঙ্গে...।’
‘থামো। আমাকে শিখিও না।’
‘গুনগুনের ব্যাপারে তুমি ইন্টারফেয়ার করছো কেন?’
শান্তা হাসে।
‘কারণ মেয়েটা আমার।’
‘কি!’
‘আজ রাতে সে ঘর ছেড়ে চলে গেছে। তাকে একমাত্র তুমিই থামাতে পার।’
ঢোক গিলে জহির। আটকে গেছে শ্বাসনালী। এক সময়ের ডাকসাইটের ছাত্র নেতা কমরেড জহির। মাইক ছাড়া বক্তৃতা দিত। মোক্তার পাড়ার মাঠের শেষ মাথা পর্যন্ত তার গলা শোনা যেত। আর সেই জহির এখন গলা ভেজাবার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছে।
শান্তা উঠে গিয়ে জহিরের পাশে সোফার হাতলে বসে। আলতো করে ঘাড়ে হাত রেখে বলেÑ
‘সাজ্জাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা টেকেনি। আমিরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে।’
চোখ বুজে শুনে যাচ্ছে জহির। নিঃশ্বাস পতনের শব্দও নেই।
‘গুনগুন মেনে নিতে পারেনি। ভেতরে ভেতরে জেদি হয়ে ওঠে। এক সময় আমাকেও অপছন্দ করে। লেখাপড়া শেষ করেনি। পার্ট টাইম জব করে। তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল আমার। বারবার মনে পড়ে, সেদিন যদি জেদ করে তোমাকেই বিয়ে করতাম তাহলে, গুনগুন আমাদের হতো।’
রাত গড়িয়ে দিনের পথে। মসজিদের খুটখুট আওয়াজ বলে দিচ্ছে সময় কত। শান্তার চোখ বেয়ে টপটপ জল পড়ছে। শান্তার হাত চেপে ধরে জহির। ক্লান্ত গলায় আস্তে আস্তে বলেÑ
‘গুনগুন কি আমিরের মেয়ে?’
‘না’
‘সাজ্জাদের ?’
‘না’
‘তাহলে ?’
চুপ করে থাকে শান্তা। ভাবতে থাকে জহির। শান্তার সঙ্গে মধুর স্মৃতিগুলোর আবছা ছায়া চোখের সামনে ভাসে। ডেস্টোফিয়ান ফিউচার। ক্রমশ এগিয়ে আসছে ধ্বংসের দিকে।

×