ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

তৃণমূলে মুক্তিযুদ্ধ-গবেষণা ॥ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা

তপন বাগচী

প্রকাশিত: ০১:২৯, ২৬ মার্চ ২০২৩

তৃণমূলে মুক্তিযুদ্ধ-গবেষণা ॥ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা

বাংলা একাডেমি পরিচালিত ‘বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

বাংলা একাডেমি পরিচালিত ‘বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও গ্রন্থপ্রকাশ’ প্রকল্পে আমি দায়িত্ব পেয়েছিলাম গোপালগঞ্জ জেলার ইতিহাস অনুসন্ধানের। মাদারীপুর জেলায় জন্ম নিয়ে কেন গোপালগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতে গেলাম, সে প্রশ্ন অনেকেরই ছিল। গোপালগঞ্জের কেউ যে স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরেই এই ধরনের কাজে অগ্রসর হয়নি, সেই প্রশ্ন আমরা তুলছি না। সেই ঘাটতি পূরণে কেউ এগিয়ে এলে, তার সমালোচনায় মুখর হওয়ার মধ্য দিয়ে নিজেদের অযোগ্যতার চিত্রটিই প্রকট হয়ে ধরা পড়ে, সেই বিষয়টি আমরা খেয়াল করি না।

জন্মসূত্রে আমার বাড়ি মাদারীপুর জেলার কেন্দুয়া ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের দক্ষিণ পাশের বাগচীবাড়িতে। আমাদের বাড়ির দক্ষিণে একটি ছোট্ট বিল। তার পরেই কোটালীপাড়া উপজেলার সাদুল্লাপুর ইউনিয়ন। ১৯৭১ সালে মাদারীপুর-গোপালগঞ্জ পৃথক জেলা ছিল না। গোপালগঞ্জ তখন ফরিদপুর জেলার একটি মহকুমা। ১৯৮৪ সালে জেলা হওয়ার আগ পর্যন্ত এটি ফরিদপুর জেলারই অন্তর্গত। তাই ফরিদপুর জেলার যে কোনো ব্যক্তিই মাদারীপুরের কিংবা গোপালগঞ্জের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে পারে।

যারা এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তারা কূপম-ূক ছাড়া কিছুই নয়। আরও একটু পিছিয়ে গিয়ে বলি, আজকের গোপালগঞ্জ জেলা একসময় মহকুমা ছিল। তারও আগে গোপালগঞ্জ ও কোটালীপাড়া থানা ছিল মাদারীপুর মহকুমারই অন্তর্গত। মাদারীপুরের কোটালীপাড়া ও গোপালগঞ্জ থানা, যশোরের কাশিয়ানী থানা ও ফরিদপুরের মুকসুদপুর থানা নিয়েই গঠিত হয় গোপালগঞ্জ মহকুমা। আর গোপালগঞ্জ থেকে জন্ম নেয় টুঙ্গিপাড়া। এই ৫টি থানাই আজকের গোপালগঞ্জ জেলা। তাই মাদারীপুর আর গোপালগঞ্জের শিকড় একই মৃত্তিকায় প্রোথিত।
বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস খুঁজতে গেলে ব্রিটিশ সিভিলিয়ানদের লেখা গেজেটিয়ার, গবেষণাগ্রন্থ, ডায়েরি কিংবা স্মৃতিকথা খুঁজতে হয়। কারণ, বাঙালি তখনো ইতিহাস লেখার কাজ শুরু করেনি। তারা যদি এই অঞ্চলের ইতিহাস লিপিবদ্ধ না করত, তা হলে বাঙালির ইতিহাসই অপূর্ণই থেকে যেত। ব্রিটিশদের লেখা ইতিহাস পড়তে পারি, বাঙালির লেখা ইতিহাস পড়তে গেলে লজ্জা লাগে!
আমি চেয়েছিলাম মাদারীপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে। কিন্তু আমার চেয়ে অধিকতর যোগ্য বিবেচনায় মাদারীপুরের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও শিক্ষক আনিসুর রহমানকে ওই দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমি সে সময়ে গাজীপুর জেলায় অবস্থিত ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে (ব্রি) সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত। গোপালগঞ্জ জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখার জন্য যারা যোগ্য, তারা কেউ আবেদন করেননি, কিংবা যোগাযোগ করেননি।

আবেদন করেছেন, বা আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, তাদের কাউকে উপযুক্ত মনে না হওয়ায়, নিকটবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দা হওয়ায় আমাকে ডেকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনে রয়েছেন শেখ হাসিনা। ব্যাপারটি আমার জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জের মনে হয়। আমি সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করি। 
বয়স হয়নি বলে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া হয়নি। সেই আক্ষেপ পুষিয়ে নেওয়ার উন্মাদনা আমাকে পেয়ে বসে। আমি তখন গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক রবীন্দ্রনাথ অধিকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তার আশ্বাসে মাঠে নামার সাহস পাই। তারপর গোপালগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক (ডিসি) ইকবাল মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনিও সহযোগিতার আশ্বাস দেন। পরে তিনি সংস্থাপন সচিব এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। 
মাঠে নেমে আমি সহযোগিতা পাই তৎকালীন থানা নির্বাহী কর্মকর্তা, পরে অতিরিক্ত সচিব ও জাতীয় গণগ্রন্থাগারের মহাপরিচালক (ডিজি)  ছড়াকার আলম তালুকদার, সাংবাদিক মোজাম্মল হোসেন মুন্না, কবি খালেক বিন জয়েনউদ্দিন, জগন্নাথ হলের প্রাক্তন ভিপি অনুপম রায়, কবি দীংকর গৌতম প্রমুখের। আমার গ্রন্থে যথাস্থানে সকলের কথা উল্লেখ রয়েছে।
গ্রন্থটি বাংলা একাডেমি থেকে যথাসময়ে প্রকাশিত হয়নি। সরকার বদলের ফলে ওই প্রকল্প সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে স্থানান্তরিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যায়। চার দলীয় জোট সরকার যে ওই বই প্রকাশ করবে না, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু ১০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ায়, আমি আমার পা-ুলিপি বাংলাবাজারের অভিজাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘ঐতিহ্য’ থেকে প্রকাশের ব্যবস্থা নিই।
বইটি প্রকাশের পরে গোপালগঞ্জে যে রকম সাড়া পাওয়ার কথা, তা পাওয়া যায়নি। নিজের ঢোল নিজে পেটাতে পছন্দ করি না বলে বইটি নিয়ে তেমন আলোচনাও হয়নি। তবে আমি বিশেষ ধন্যবাদ দিতে চাই, ‘পাক্ষিক মুকসুদপুর সংবাদ’ পত্রিকার সম্পাদক এবং বর্তমানে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি হায়দার হোসেনকে। তার কী খেয়াল হলো, আমাকে সে এই গ্রন্থের জন্য সংবর্ধনা জানাতে চায়। অনেক দ্বিধা সত্ত্বেও আমি সম্মত হই, অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) এমএ খায়েরের উপস্থিতি এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধদের থাকার কথা শুনে।

গোপালগঞ্জের মানুষ কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে বিশিষ্ট যেমন- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি, বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল ফারুক খান এমপি, ব্যাংকার কাজী আকরামউদ্দিন আহমেদ, সাবেক মন্ত্রী কাজী ফিরোজ রশীদ, শেখ হেলাল এমপি, ঢাকা দক্ষিণের বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস প্রমুখ নেতার সঙ্গে আমার সরাসরি পরিচয় নেই। যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন আমাদের এমপি, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান আমাদের উপজেলার মানুষ- তবু তাদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি।

আমাদের জেলার এমপি নূরে আলম চৌধুরী লিটনের সঙ্গেও কখনো দেখা হয়নি আমার।  
আমি মাঠে কাজে করেছি, মাঠের মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয়। তবু তথ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন মানুষের কাছে যেতে হয়েছে। কোটালীপাড়ার তথ্য সংগ্রহের জন্য আমি কিংবদন্তিতুল্য সাংবাদিক নির্মল সেন, প্রাক্তন এমপি লক্ষ্মীকান্ত বল, রাজনীতিবিদ কানাই গৌতম, সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত, ছড়াকার খালেক বিন জয়েনউদ্দিন, অ্যাডভোকেট চিত্তরঞ্জন বল, আরতি রানী বাড়ৈ, সমাজকর্মী আশালতা বৈদ্য, কবি বরীন্দ্রনাথ অধিকারী,  বীর মুক্তিযোদ্ধ সহদেব বৈদ্য, প্রকৌশলী গোপালকৃষ্ণ বাগচী, কবি দীপংকর গৌতম, সংস্কৃতিকর্মী আবু সুফিয়ান চৌধুরী কুশল, ড. শিশির মল্লিক প্রমুখের সহযোগিতা গ্রহণ করি।

এ ছাড়া সংবাদপত্র ও বিভিন্ন পুস্তক-পুস্তিকার রচনা তো ব্যবহার করেছিই। হেমায়েত-বাহিনীর তথ্য পেয়েছি বিশেষত খালেক বিন জয়েনউদ্দিনের মাধ্যমে। ঢাকায় তার আজিমপুরের বাসায় গেলে তিনি হেমায়েতউদ্দিনের লেখা একটি পা-ুলিপির ফটোকপি দেন, যাতে হেমায়েত বাহিনীর কর্মকা- সম্পর্কে তথ্য রয়েছে। আমি ওই তথ্য যাচাই করে যতটুকু নিঃসন্দেহ হয়েছে, ততটুকু ব্যবহার করেছি। পরে দেখি যে, ওই পা-ুলিপি একটু ঘষে-মেজে বই আকারে বের হয়েছে।

লেখকের নাম লে. ক. এসআইএম নূরুন্নবী খান বীরবিক্রম (বরখাস্ত)। বইয়ের নাম ‘মুক্তিযুদ্ধে হেমায়েত বাহিনী।’ এর পরে, ২০০৪ সালে, কর্নেল (অব) মোহাম্মদ সফিক উল্লাহ বীরপ্রতীক রচিত ‘একাত্তরের রণাঙ্গন : গেরিলাযুদ্ধ ও হেমায়েতবাহিনী’ নামে আরেকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এতে কোটালীপাড়া তো বটেই হেমায়েতবাহিনীর ওপরেই ৫০৪ পৃষ্ঠা লিখিত হয়েছে। ভাবুন! সে বইয়ের তথ্য সংগ্রহ করতে কোটালীপাড়াতে যেতে হয়নি। লেখক তা স্বীকারও করেছেন। যাদের কথা লেখা হয়েছে, তারাই তথ্য এগিয়ে দিয়েছেন। লেখকের এই সততার প্রশংসা করি। কিন্তু ইতিহাসের তথ্য ব্যবহার করার আগে একটু যাচাই না করলে ভুল তো হয়ই, পক্ষপাতিত্বের দায়ও বহন করতে হয়।
কোটালীপাড়ায় হেমায়েতবাহিনীর বীরত্বপূর্ণ কর্মকা- নিয়ে কারও কোনো দ্বিমত নেই। সব কৃতিত্ব যাবে দলনেতার নামে, এ কথা সত্য। কিন্তু যখন গোটা বাহিনীর ইতিহাস লেখা হবে, তখন কি দলের অন্য যোদ্ধাদের বিবরণ যথাযথ হওয়া দরকার নয়? হেমায়েতবাহিনীর নাম উচ্চারণ করলে দ্বিতীয় যে নামটি চলে আসে, তা কমলেশ বেদজ্ঞ। হেমায়েতউদ্দিনের বীরবিক্রম খেতাব পাওয়ার পেছনে, অর্থাৎ এই বাহিনীর সফল অপারেশনের পেছনে যে শিক্ষিত ও সাহসীন যোদ্ধার অবদান বেশি ছিল, তিনি কমলেশ বেদজ্ঞ।

কিন্তু ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, কোটালীপাড়ার এই কৃতী সন্তান, হেমায়েতবাহিনীর দ্বিতীয় পুরুষ কমলেশ বেদজ্ঞকে প্রাণ হারাতে হয় স্বাধীন বাংলাদেশে। আরও নির্মম এই যে, কমলেশ বেদজ্ঞসহ ৫ খুনের আসামি হিসেবে সাজা ভোগ করেছেন হেমায়েত বাহিনীপ্রধান হেমায়েতউদ্দিন বীরবিক্রম। কমরেড ওয়ালিউর রহমান লেবু, কমলেশ বেদজ্ঞ, বিষ্ণুপদ, মানিক চক্রবর্তী ও শেখ লুৎফর রহমান গঞ্জর খুন হয় ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের তিনদিন পরে ১০ মার্চ। নৃশংসভাবে তাদের খুন করা হয়। যেহেতু হেমায়েত ছিলেন প্রধান আসামি, তাই তার দেয়া তথ্যে আরেক বীরপ্রতীক কর্নেল (অব) মোহাম্মদ সফিক উল্লাহ লেখেন, 
‘নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ সন্তান শিক্ষক শ্রী কমলেশ চন্দ্র বেদজ্ঞ ১৯৭১ সালের হেমায়েতবাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন। রাজনীতিেিত তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। কমলেশের সাহস ও দক্ষতার জন্য হেমায়েত তাকে মুক্তিযোদ্ধা জল্লাদ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কারণ তাকে দিয়ে বিচারে চরম শাস্তিপ্রাপ্ত বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্যদের ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হতো। হিন্দু হাতে প্রকাশ্য দিবালোকে মুসলমানের মরণ! হোক না পশ্চিমা নরপিশাচ সৈনিক!! তারা মুসলমান তো!!! হিন্দু ব্রাহ্মণের গুলিতে মুসলমানের মরণে দারুণ ক্ষেপা এলাকার মুসলমান।’ 
[কর্নেল (অব) মোহাম্মদ সফিক উল্লাহ বীরপ্রতীক রচিত ‘একাত্তরের রণাঙ্গন : গেরিলাযুদ্ধ ও হেমায়েতবাহিনী’, ২০০৪, পৃ. ২৯৫]
‘নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিচয়ে’র চেয়ে কমলেশ বেদজ্ঞের কমিউনিস্ট এবং শিক্ষক পরিচয়টাই বড়। কিন্তু তাকে ‘নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিচয়’ বলে সম্প্রদায়গত সঙ্কীর্ণতার পরিচয় দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে যারা প্রাণ দিয়েছে তাদের কোনো জাত-পরিচয় ছিল না। তারা পাকিস্তানের দোসর এবং বাংলাদেশের শত্রু। তাদের যারা যুদ্ধক্ষেত্রে হত্যা করেছে, তাদেরও কি কোনো জাত-পরিচয় ছিল? তাদের একটা পরিচয় মুক্তিযোদ্ধা। কোটালীপাড়ায় অন্তত যুদ্ধকালে কোনো সাম্প্রদায়িক অবস্থা বিরাজ করেনি। কিন্তু লেখক এখানে নিজের সঙ্কীর্ণ মনের পরিচয়টাকেই কেন প্রকট করে তুললেন, তা বোঝা গেল না। লেখক আরও লিখেছেন,
‘মুসলমানের মনের ধূমায়িত ক্ষোভ ছাইচাপা আগুনের মতো বাড়তে থাকে। স্বাধীন দেশে কমলেশ বেদজ্ঞের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। প্রাণে বাঁচতে তাঁর কোটালীপাড়া ছেড়ে গোপালগঞ্জে আশ্রয় নিতে হয়।’ (পৃ. ২৯৬)
কী নিদারুণ অপব্যাখ্যা। প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা হলে কমলেশ নির্বাচনেই অংশ নিতেন না। মুক্তিযুদ্ধের পরে কমলেশ আরও বৃহত্তর পরিসরে তার রাজনৈতিক কর্মকা- বিস্তার করেন। তিনি কোটালীপাড়া থানা নয়, গোপালগঞ্জ মহকুমা নয়, ফরিদপুর জেলার মধ্যেই উল্লেখযোগ্য নেতা। এমনকি জাতীয় পর্যায়ের কমিউনিস্ট আন্দোলনেও তার অবদান আজ স্বীকৃত। কোটালীপাড়ার ভয়ে গোপালগঞ্জে গিয়ে কি বাঁচা যায়? কমলেশ তো কেবল কোটালীপাড়ায় যুদ্ধ করেননি, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও বরিশাল মহকুমায় বিস্তৃত ছিল তার কর্মকা-। কমলেশের বিরুদ্ধে কোটালীপাড়ার মুসলমানদের মনে সামান্যতম বিদ্বেষও ছিল না।

ব্রাহ্মণ তথা হিন্দু হওয়ার জন্য যদি কমলেশকে খুন করা হয়, তা হলে ওয়ালিউর রহমান ও শেখ লুৎফর রহমানকে কেন খুন করা হলো একই সময়ে একই প্রক্রিয়ায়? কমলেশ বেদজ্ঞের নির্বাচনী প্রতিপক্ষও মুসলমান ছিল না। তাই এ রকম ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু কমলেশসহ ৫ খুনের দায় এড়াতে এ রকম তথ্য দিয়ে গ্রন্থ রচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে আমাদের ধারণা। কিন্তু সেই চেষ্টা কি ফলপ্রসূ হতে পারে?
কোটালীপাড়ার নারী মুক্তিযোদ্ধা আমাদের গৌরবের ব্যাপার। বিশেষ করে আশালতা বৈদ্যের নাম আমরা স্মরণ করতে চাই। তার নেতৃত্বে যে সব নারী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তাদের সবার প্রতি লাল সালাম। কিন্তু  তার নেতৃত্বে ৪৫ জন নারীসহ মোট ৬৫ জন নারী সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বলে মোহাম্মদ সফিক উল্লাহর ওই গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি যাচাই করে দেখা দরকার। ঘটনা সত্য হলে, আমাদের গৌরব বাড়বে, আর সত্য না হলে ইতিহাস বিকৃতির দায় নিতে হবে।

যাই হোক, কোটালীপাড়ার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরও অরেক গবেষণার সুযোগ রয়েছে। সম্প্রতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সহদেব বৈদ্য তার একাত্তরে ডায়েরি প্রকাশ করেছেন। এটি কোটালীপাড়ার ইতিহাসের এক বিশ^স্ত দলিল। কোটালীপাড়ার যুদ্ধের ইতিহাস কেবল কোটালীপাড়াতে নয়, গোপালগঞ্জে, গৌরনদীতে, কালকিনিতে, রাজৈরে, মুকসুদপুরের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তাই সঙ্কীর্ণ গ-ি ভেঙে আরও উদার দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে এলো কেবল কোটালীপাড়ার ইতিহাস সমৃদ্ধ হবে, তাই নয়, কোটালীপাড়ার কৃতী সন্তান কমলেশ বেদজ্ঞসহ ৭ জন দেশপ্রেমিকের খুনের রহস্যও উন্মোচিত হবে। কমলেশ বেদজ্ঞ একজন ব্যক্তিমাত্র নন, কোটালীপাড়ার ইতিহাসের অংশ। তার সঙ্গে শহীদ হওয়া ওয়ালিউর রহমান লেবুর অবদান তো কোটালীপাড়ার মধ্যে সীমিত নয়, আন্তর্জাতিক পরিম-লেও সুবিদিত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার সঙ্গে সঙ্গে এদের অবদানের ইতিহাস জানাটাও বর্তমান প্রজন্মের মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় বলে বিবেচনা করি।

লেখক : কবি ও ফোকলোরবিদ।

×