
ছবি: সংগৃহীত
“আমি মৃত্যু হয়ে এসেছি, এসেছি পৃথিবী ধ্বংসকারী হিসেবে”—এই কথাটি বলেছিলেন মার্কিন পদার্থবিদ জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহাইমার। যিনি পরমাণু বোমার জনক হিসেবে পরিচিত, বাস্তব জীবনের ‘প্রমিথিউস’ বলা হয় তাকে। নিজের আবিষ্কারকে কেন্দ্র করে আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হলেও আইনগতভাবে তিনি পরমাণু হোমবার জন্য দোষী বিবেচিত হননি। কিন্তু তাতে কি! বড় বড় বোমার মতো ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র, যেগুলো সবকিছু ধ্বংস করতে সক্ষম—আজ সেগুলোর ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে বিশ্বজুড়ে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট—সিপ্রির তথ্যমতে, বিশ্বের অনেক দেশ আজ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে। সিপ্রি সতর্ক করে বলছে, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারির ব্যবস্থাগুলো এখন খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমন সময়ে যখন পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে উদ্বেগ বেড়েই চলেছে, তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মহাকাশ প্রযুক্তির প্রসার সেই উদ্বেগকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে।
বর্তমানে বিশ্বের ৯টি দেশের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি দেশ তাদের অস্ত্র কর্মসূচির আধুনিকায়ন চালিয়ে যাচ্ছে। এই আধুনিকায়নের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে অস্ত্রগুলোর উন্নয়ন ও আধুনিক প্রযুক্তির সংযুক্তি।
সিপ্রির ২০২৫ সালের ইয়ারবুক শীর্ষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্বে পারমাণবিক ওয়ারহেড ও সেলের সংখ্যা ছিল ৬৪,০০০, যা বর্তমানে নেমে এসেছে ১২,২৪১-এ। তবে এই হ্রাসের ধারা এখন উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
সিপ্রির পরিচালক ড্যান স্মিথ জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, বর্তমানে পারমাণবিক অস্ত্র সংখ্যা কমানোর কোনো বাস্তব পদক্ষেপ আর দেখা যাচ্ছে না। তিনি জানান, পারমাণবিক শক্তিধর নয়টি দেশ হলো—যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া এবং ইসরায়েল। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া একাই বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্রের প্রায় ৯০ শতাংশের মালিক।
১৯৮০’র দশক থেকেই বিজ্ঞানীরা পরিবেশের ওপর পারমাণবিক বিস্ফোরণের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, পরমাণু বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট বিশাল দাবানল থেকে উৎপন্ন ধোঁয়ায় ‘পারমাণবিক শীতকাল’ দেখা দিতে পারে। এই ধোঁয়া সূর্যালোক আটকে রাখবে এবং তাপমাত্রা হঠাৎ কমে যাবে, যার ফলে বিশ্বব্যাপী কৃষি ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে।
একটি পরমাণবিক যুদ্ধ শুরু হলে বহু শহর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। এসব আগুন থেকে সৃষ্ট কালি, ঝুল, কার্বন কণা ও ধোঁয়া বৈশ্বিক বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়বে। এই কার্বন কণা স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে কয়েক মাস থেকে শুরু করে কয়েক বছর পর্যন্ত থেকে যেতে পারে। ফলে সূর্যের আলো পৃথিবীতে পৌঁছাবে না, এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা ব্যাপক হারে কমে যাবে।
বিপরীতে, স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের তাপমাত্রা বেড়ে যাবে, যার ফলে ওজন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ওজন স্তর ক্ষয় হলে অতি বেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবীর পৃষ্ঠে এসে পড়বে। অন্যদিকে, তাপমাত্রা ০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে সমুদ্রে বরফের পরিমাণ বেড়ে যাবে। তুষারপাত হবে বেশি ও দীর্ঘস্থায়ী, যার ফলশ্রুতিতে খাদ্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে।
সমুদ্রের তাপমাত্রাও কমে যাবে। এমনকি পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন কণা সরে গেলেও এবং তেজস্ক্রিয়তা কমে এলেও সমুদ্রগুলোর তাপমাত্রা আগের অবস্থায় ফিরে আসতে বহু বছর লেগে যাবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান এবং তার সরাসরি প্রভাব পড়বে বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহে।
ফলে দেখা দিতে পারে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট। এই সংকট কয়েক দশক ধরে চলতে পারে। আর যেটুকু খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হবে, তা তেজস্ক্রিয়তা দ্বারা দূষিত হওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে। এমনকি কোনো দেশ যদি সহানুভূতিশীল হয়ে অন্য দেশকে খাদ্য সাহায্য করতে চায়, তবুও সমুদ্রপথে বরফের আধিক্যের কারণে পরিবহন হয়ে পড়বে কষ্টসাধ্য।
একটি বড় মাত্রার পারমাণবিক যুদ্ধের পর যাঁরা বেঁচে থাকবেন, তাদের অনেকেই বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় দুর্ভিক্ষে মারা যাবেন। এই মৃত্যুর সংখ্যা লাখ থেকে শুরু করে কয়েক শ’ কোটিতেও পৌঁছাতে পারে।
শেখ ফরিদ