ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২

আপনার শরীরে আছে পারমাণবিক বোমার চিহ্ন!

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১:২৩, ২৮ জুলাই ২০২৫

আপনার শরীরে আছে পারমাণবিক বোমার চিহ্ন!

ছবি: সংগৃহীত

১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই, নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে ইতিহাসের প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ ‘ট্রিনিটি’ ঘটানো হয়। ১৮.৬ কিলোটনের সেই বিস্ফোরণ শুধু যুদ্ধের ইতিহাসকেই নয়, মানব সভ্যতার গঠনেও গভীর প্রভাব ফেলে। সেই ঘটনার ৮০ বছর পার হলেও তার এক ‘নীরব চিহ্ন’ আজও আমাদের শরীরের ভেতর বিরাজমান, যা বিজ্ঞানীরা ‘বম্ব স্পাইক’ নামে চিহ্নিত করেছেন। এটি রয়েছে আমাদের দাঁত, চোখ, মস্তিষ্ক এমনকি ডিএনএ-তে।

১৯৫০-এর দশকে পৃথিবীর বহু দেশে ওপেন-এয়ার পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার ফলে বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে কার্বন-১৪ নামক রেডিও-আইসোটোপ ছড়িয়ে পড়ে। এই কার্বন-১৪ গাছপালা, প্রাণী ও পানি হয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। বিশেষ করে যারা ১৯৫০ থেকে ১৯৬৩ সালের মধ্যে জন্ম নিয়েছেন, তাঁদের শরীরের টিস্যুতে এই অতিরিক্ত কার্বন-১৪ এখনো শনাক্তযোগ্য। যদিও এটি কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে না, তবে এটি সময় চিহ্নিত করার এক দুর্লভ উপায় হিসেবে বিজ্ঞানে ব্যবহৃত হচ্ছে।

 এর সাহায্যে বিজ্ঞানীরা নির্ধারণ করতে পারছেন কে কখন জন্ম নিয়েছেন বা মারা গেছেন, কোনো প্রাণী ঠিক কোন সময়ে মারা গেছে, পুরনো ওয়াইনের সঠিক উৎপাদন সাল কী, এমনকি মানুষের মস্তিষ্কে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় নতুন নিউরন জন্মায় কিনা, তাও জানার উপায় তৈরি হয়েছে।

বিশেষ করে কারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের জীববিজ্ঞানী কির্সটি স্পলডিং গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, মানুষের শরীরের কোষ যেমন চর্বি কোষ বা নিউরন এর বয়স নির্ধারণ সম্ভব হয়েছে এই বম্ব স্পাইক বিশ্লেষণের মাধ্যমে। ২০১৩ সালের এক গবেষণায় স্পলডিং ও তাঁর সহকর্মীরা প্রমাণ করেন, হিপোক্যাম্পাসে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থাতেও নতুন নিউরন জন্মায়। এই আবিষ্কার আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানে এক বিপ্লব ঘটায় এবং ভবিষ্যতের থেরাপিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

ফরেনসিক বিজ্ঞানেও এই পদ্ধতির সফল ব্যবহার ঘটেছে। ২০১০ সালে ইতালির এক লেকে পাওয়া মৃতদেহের বয়স নির্ধারণে বম্ব স্পাইক বিশ্লেষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আবার, ২০০৪ সালে ইউক্রেনের একটি গণকবরে পাওয়া চুলের নমুনা পরীক্ষা করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের এক যুদ্ধাপরাধের সময়কাল নির্ধারণ সম্ভব হয়।

বম্ব স্পাইক শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য গবেষণাতেও বিস্ময়করভাবে সহায়ক। অ্যাডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ওয়াইনের আঙ্গুরে থাকা কার্বন-১৪ বিশ্লেষণ করে নির্ভুলভাবে উৎপাদন সাল নির্ধারণে সক্ষম হয়েছেন। একইভাবে, গ্রিনল্যান্ডের গভীর সাগরে থাকা শতবর্ষী হাঙরের চোখের লেন্স পরীক্ষা করে জানা গেছে, তারা ৪০০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে।

এই বোমা চিহ্ন এখন ভূতত্ত্বেও ব্যবহৃত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা ২০২৩ সালে কানাডার ক্রফোর্ড হ্রদের তলায় এক নির্দিষ্ট স্তরে কার্বন-১৪, প্লুটোনিয়াম, সিজিয়াম-১৩৭সহ অন্যান্য মানবসৃষ্ট উপাদানের উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন। তাই, তাঁরা প্রস্তাব করেছেন এটি হোক “অ্যানথ্রোপোসিন যুগ”-এর আনুষ্ঠানিক সূচনার প্রতীকী ‘গোল্ডেন স্পাইক’। যদিও ২০২৪ সালে এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয় এবং আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পিছিয়ে যায়, তবুও এই হ্রদ এবং কার্বন-১৪ বিশ্লেষণ ভবিষ্যতের গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

যদি কখনো এই যুগ চিহ্নিত হয়, তাহলে বলা যেতে পারে, আমাদের শরীরের ভেতরে থাকবে সেই যুগের একটি চিরস্থায়ী চিহ্ন। কারণ আগামী প্রজন্মের দেহে এমন কার্বন-১৪ আর পাওয়া যাবে না এই অতিরিক্ত মাত্রা এখন ধীরে ধীরে কমে আসছে।

একদা ধ্বংসের প্রতীক পারমাণবিক বোমা আজ বিজ্ঞানের অন্যতম গবেষণামূলক উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের শরীর এখন শুধু পারমাণবিক ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষীই নয়, বরং ভবিষ্যতের জ্ঞান ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক শক্তিশালী তথ্য-ভাণ্ডার।

মুমু ২

×