
ছবি: সংগৃহীত
চীন সম্পূর্ণ আন্ডারওয়াটার ডেটা সেন্টার তৈরি করে বিশ্ব প্রযুক্তি অঙ্গনকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। হাইনান ও সাংহাইয়ের উপকূলের কাছে বিশাল সিলিন্ডার আকৃতির ডেটা পড সমুদ্রের তলায় স্থাপন করা হচ্ছে। এই যুগান্তকারী প্রযুক্তির মূল উদ্দেশ্য হলো সমুদ্রের ঠান্ডা পানির প্রাকৃতিক শীতলীকরণ শক্তি ব্যবহার করে ডেটা সেন্টারের এনার্জি খরচ ৩০% কমিয়ে আনা।
কেন সমুদ্রের তলায় ডেটা সেন্টার?
এই প্রকল্পের পিছনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে:
শীতলীকরণের সুবিধা: ডেটা সেন্টারের সার্ভারগুলো প্রচুর তাপ উৎপন্ন করে। সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা (সাধারণত ৫-১০°C) প্রাকৃতিকভাবে এই তাপ শোষণ করে। এর ফলে এয়ার কন্ডিশনার বা অন্যান্য কুলিং সিস্টেমের প্রয়োজন কমে যায়, যা বিদ্যুৎ খরচ ব্যাপক হ্রাস করে।
পরিবেশবান্ধব শক্তি: এই আন্ডারওয়াটার ডেটা সেন্টারগুলো মূলত অফশোর উইন্ড এনার্জি (সমুদ্রের বায়ু শক্তি) দ্বারা চালিত হয়, যা কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসে এবং পরিবেশের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এআই ও সুপারকম্পিউটিংয়ের ভবিষ্যৎ: চীন তাদের দ্রুত বিকাশমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ক্লাউড কম্পিউটিং এবং ব্লকচেইন প্রযুক্তির জন্য এই ডেটা সেন্টারগুলো ব্যবহার করছে। এর মাধ্যমে গুগল, মাইক্রোসফটের মতো টেক জায়ান্টদের চেয়ে দ্রুতগতি ও কম খরচে ডেটা প্রসেসিং সম্ভব হচ্ছে।
কীভাবে কাজ করে এই প্রযুক্তি?
এই অভিনব ডেটা সেন্টারগুলো একটি সিলড পড সিস্টেমে কাজ করে:
সিলড পড সিস্টেম: স্টেইনলেস স্টিল ও শক্তিশালী গ্লাসের তৈরি বিশাল পডগুলোর ভেতরে সার্ভার র্যাক স্থাপন করা হয়। এই পডগুলো সম্পূর্ণভাবে জলরোধী।
স্বয়ংক্রিয় মেইনটেন্যান্স: রোবট ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) ব্যবহার করে পানির নিচেই সার্ভার মেরামত ও আপগ্রেড করার ব্যবস্থা রয়েছে, যা মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই রক্ষণাবেক্ষণের সুযোগ দেয়।
সুরক্ষা: সমুদ্রের লবণাক্ততা, চাপ এবং অন্যান্য প্রতিকূল পরিস্থিতি সহ্য করার জন্য এই পডগুলোতে বিশেষ ম্যাটেরিয়াল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী প্রভাব
চীনের এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি এবং পরিবেশের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে:
এনার্জি সাশ্রয়: বর্তমানে বিশ্বের মোট বিদ্যুতের প্রায় ৪০% ডেটা সেন্টারে ব্যবহৃত হয়। এই প্রযুক্তি সফল হলে গ্লোবাল কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে এটি বিশাল ভূমিকা রাখবে।
চীনের টেক আধিপত্য: চীন এই মুহূর্তে ১০টিরও বেশি আন্ডারওয়াটার ডেটা সেন্টার নির্মাণ করছে, যা তাদের AI ও ক্লাউড কম্পিউটিং খাতে বিশাল সুবিধা দেবে এবং বৈশ্বিক টেক আধিপত্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।
অন্যান্য দেশের পদক্ষেপ: মাইক্রোসফট ২০১৮ সালে "Project Natick" নামে একটি পরীক্ষামূলক আন্ডারওয়াটার ডেটা সেন্টার টেস্ট করেছিল। তবে চীনই প্রথম দেশ যারা এই প্রযুক্তিকে বাণিজ্যিকভাবে চালু করেছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ এই প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা ত্বরান্বিত করছে এবং ভারত ও জাপানও একই ধরনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
ড. লি ঝাও, একজন টেকনোলজি অ্যানালিস্ট (বেইজিং), মন্তব্য করেছেন: "এটি শুধু টেক নয়—জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় একটি বড় পদক্ষেপ।"
চ্যালেঞ্জগুলো কী?
এই যুগান্তকারী প্রযুক্তির কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে:
উচ্চ নির্মাণ খরচ: প্রাথমিক নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি।
সমুদ্রের পরিবেশগত প্রভাব: সমুদ্রের ইকোসিস্টেম এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ওপর এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে এখনো উদ্বেগ রয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদে মেইনটেন্যান্স জটিলতা: পানির নিচে দীর্ঘমেয়াদী রক্ষণাবেক্ষণ কতটা সহজ হবে, তা এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়।
চীন ২০২৬ সালের মধ্যে ৫০টিরও বেশি আন্ডারওয়াটার ডেটা পড স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে। যদি এই প্রযুক্তি সফল হয়, তাহলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে ডেটা সেন্টারগুলো শহরের বদলে সমুদ্রের তলায় দেখা যেতে পারে!
সূত্র: South China Morning Post, MIT Technology Review
সাব্বির