ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

বর্তমান অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন কল্পনাও করা যায় না: জামায়াত আমির

তাহমিন হক ববী ও আব্দুস সালাম, রংপুর

প্রকাশিত: ২০:৪৭, ৪ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ২০:৪৭, ৪ জুলাই ২০২৫

বর্তমান অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন কল্পনাও করা যায় না: জামায়াত আমির

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের কল্পনাও করা যায় না। কেউ যদি আওয়ামী ফ্যাসিবাদের আমলের নির্বাচনের স্বপ্ন দেখে থাকেন, সেই স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করব। কোনো প্রশাসনিক ক্যু করতে দেওয়া হবে না। আগামী নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র দখল ও কালো টাকার খেলা চলবে না।

আজ শুক্রবার (৪ জুলাই) বিকালে রংপুর জিলা স্কুল মাঠে জামায়াতের বিভাগীয় জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সব খুনির বিচার, প্রয়োজনীয় সব সংস্কারের পর নির্বাচনসহ চার দফা দাবিতে এই জনসভার আয়োজন করেছে জামায়াতে ইসলামীর রংপুর মহানগরী ও জেলা শাখা।

জনসভা থেকে আগামী নির্বাচনে রংপুর বিভাগের ৩৩টি আসনে জামায়াতের প্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে জামায়াত আমির ‘আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে’ দাবি করে বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কতগুলো মৌলিক সংস্কার অবশ্যই করতে হবে। আমরা সেই সংস্কারগুলো আদায় করে ছাড়ব। বর্তমান অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচনের কল্পনাও করা যায় না। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনও আদায় করে ছাড়ব। তিনি বলেন, জনতার ম্যান্ডেট নিয়ে যারা ক্ষমতায় যাবে, তাদের অভিনন্দন জানাতে জামায়াতে ইসলাম এখন থেকেই প্রস্তুত। তবে জামায়াত ক্ষমতায় গেলে চব্বিশের ছাত্র-জনতাকে বুকে নিয়ে এগিয়ে যাব।

তিনি প্রশাসনকে নিরপেক্ষ থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকলে জামায়াত তাদের পাশে থাকবে, নাহলে সবার আগে জামায়াত তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।

তিনি আরও বলেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা বহু ধরনের ষড়যন্ত্রের কথা শুনতে পাচ্ছি, বহু ধরনের কথা ময়দানে শুনতে পাচ্ছি। বহু ধরনের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আলামত বুঝতে পারছি। আমরা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিই, এই শেখ হাসিনা, তার হাতে সকল বাহিনী ছিল। দোর্দন্ড প্রতাপ ছিল, জায়গায় জায়গায় নিজের লোক বসিয়েছিল। মাস্তানদের দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিল। কিন্তু যখন জনগণের জাগরণ, জনগণের বিস্ফোরণ হয়েছে, তখন কি তাকে আর কেউ রক্ষা করতে পেরেছে? তাহলে যেই জনগণ এতো মূল্য দিয়ে একটা পরিবর্তন এনেছে, সেই জনগণ আরেকটা ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে দেবে না ইনশাআল্লাহ।

জামায়াত আমির বলেন, আমরা কথা দিচ্ছি ফ্যাসিবাদ বিরোধী এই লড়াই ততদিন চলবে, যতদিন দেশে ফ্যাসিবাদের সামান্য চিহ্নও থাকবে। ফ্যাসিবাদেকে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত আমাদের লড়াই কেউ থামাতে পারবে না। তিনি বলেন, কথা ছিল আগামী নির্বাচনে জামায়াত ক্ষমতায় এলে কারো কোন ক্ষতি করবে না। আমরা সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো। তিনি বলেন মব আমরা চাই না। আমরা মবের ঘোর বিরোধী। আমাদের মধ্যে কোনো মব নাই। দেখবেন এ সমস্ত মবে জামায়াতে ইসলামীর কোনো কর্মী-সমর্থক কোথাও জড়িত নাই।

ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আগে নির্বাচনের পরিবেশ অবশ্যই তৈরি করতে হবে। এই পরিবেশ তৈরির জন্য সংস্কারের প্রশ্নগুলো উঠেছে। আমরা আশা করি, যদি মৌলিক বিষয়গুলোতে কার্যকর সংস্কার করা যায় তাহলে আলহামদুলিল্লাহ একটা ভালো নির্বাচন হবে, এতে এবং যদির কোনো সুযোগ নেই। সংস্কার করতে হবে এবং ভালো নির্বাচনও করতে হবে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির আরও বলেন, ‘প্রথমে অধ্যাপক গোলাম আযম কেয়ারটেকার সরকারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, আমরা সেই প্রস্তাবেই ফিরে যাব। ধরে আল্লাহ ছাড়ে কে, যার প্রমাণ হিসেবে আল্লাহ শেখ হাসিনাকে ধরেছে। আপনারা জানেন, আপনার পার্শ্ববর্তী এলাকায় পাটগ্রামে কি করা হয়েছে, তারা ক্ষমতায় না গিয়ে পাটগ্রাম থানায় হামলা, পুলিশের ওপর নির্যাতন ও দখলসহ বিভিন্ন অনিয়ম করেছে। বাংলাদেশকে পাটগ্রাম বানিয়ে ফেলেছে। এ অবস্থায় নির্বাচন সম্ভব নয়। একটি দল নিজের লোকদের ক্ষতি করে ক্ষমতায় যেতে দ্বিধা করছে না, লুটপাট, নৈরাজ্য সৃষ্টি করে পূর্বের সরকারের ক্ষমতায় যেতে চায়। আর এই বাংলাদেশে কোনো ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে দেওয়া হবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন হবে না।’

‘ভালো টাকার খেলা খেলতে দেওয়া হবে না। আমাদের সময় সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু কিছুই থাকবে না। আমরা জনগণের সেবক হয়ে থাকতে চাই। আপনাদেরকে উপহার হিসেবে এটিএম আজহারুলকে দিয়ে গেলাম, যদিও অনেকের চেয়ে উনি বয়সে বড়, তবু আপনার সন্তানের মতো করে তাকে দেখবেন, তার পাশে থাকবেন।’

তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন আমাদের দলের অনেক লোককে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে। আমরা সেদিকে যাইনি। এদেশের মাটিতে একসময় বিচার হবেই, আমরা প্রতিহিংসার রাজনীতি পছন্দ করি না। আবু সাঈদরা জীবন দিয়েছে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়, তারা জীবন দিয়েছে এদেশের ফ্যাসিস্টকে উৎখাত করার জন্য ও দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে। জনগণ আর কোনো ফ্যাসিস্ট সরকারকে দেখতে চায় না, জনগণের বিস্ফোরণে হাসিনা সরকার চলে যেতে হয়েছে, আবার কেউ ফ্যাসিবাদ তৈরি করতে চাইলে তাদের পরিণত তার চেয়ে বেশি খারাপ। জামায়াত ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশ কোরআন ও হাদিসের আলোকে পরিচালিত হবে।’

রংপুর মহানগরের আমির এ টি এম আজম খানের সভাপতিত্বে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল হালিম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, জামায়াতে ইসলামের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরোয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম বুলবুল, বাংলাদেশ ছাত্রশিবির কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, জামায়াত ইসলামের নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমানসহ জামায়াতের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা আমির ও অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

উল্লেখ্য, দীর্ঘ ১৭ বছর পর রংপুরে অনুষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামীর জেলা স্কুল মাঠে বিভাগীয় জনসভা বিকেল ৩টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শুক্রবার (৪ জুলাই) জুমার নামাজের পরই সভার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সমাগমে কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছে রংপুর জিলা স্কুল মাঠ। লোকসমাগম মাঠ ছেড়ে উপচে পড়েছে সড়কে।

রংপুর বিভাগের আট জেলার নীলফামারী, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও,লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলাসহ আশপাশের উপজেলা থেকে আসা বিভিন্ন পর্যায়ের দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সরব উপস্থিতিতে শুরু হওয়া এই জনসভায় নারীদের জন্য বক্তব্য শোনার ব্যবস্থা ছিল। জনসভায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও আহত যোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন, ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।

এদিকে সকাল থেকেই বিভিন্ন স্লোগানে জনসভাস্থল মুখরিত হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে ‘আল্লাহর আইন চাই’, ‘সৎ লোকের শাসন চাই’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয় জিলা স্কুল মাঠ। ১৭ বছর পর রংপুরে জামায়াতের জনসভা, নেতাকর্মীদের ঢল জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সব খুনির বিচার, প্রয়োজনীয় সব সংস্কারের পর নির্বাচনসহ চার দফা দাবিতে রংপুরে এই জনসভা করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।

এই জনসভা ঘিরে সকাল থেকেই জনসভাস্থলে নেতাকর্মীরা আসতে শুরু করেন। দূর-দূরান্ত থেকে রিকশা, অটোরিকশা, ভ্যান, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানে জনসভায় জড়ো হন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

জনসভায় বিশেষ বক্তা ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, মাওলানা আব্দুল হালিম, ঢাকা দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল, উত্তরের আমির মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ মাওলানা মমতাজ উদ্দিন, অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান। এছাড়া জামায়াতের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা বক্তব্য রাখেন জনসভায়।

এদিকে জামায়াতের বৃহৎ এই সমাবেশকে ঘিরে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থায় ছিল রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ। রংপুর নগরীর পুলিশ কমিশনার মজিদ আলীসহ পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা সমাবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়ে চার স্তরের নিরাপত্তা রাখেন জনসভা ঘিরে।

এর আগে আওয়ামী লীগ জোটের পতনের পর প্রথম নীলফামারী বড় মাঠে সমাবেশ করেন জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান। এরপর জলঢাকা, ডোমার ও সৈয়দপুরে পথসভা করেছিলেন তিনি। বলতে গেলে দলটির নীলফামারীতে বৃহৎ সমাবেশ হয়েছিল। এছাড়া রংপুরের পাগলাপীর, মিঠাপুকুর, পীরগঞ্জ ও গাইবান্ধা,পঞ্চগড় এবং লালমনিরহাটে স্মরণকালের বৃহৎ সমাবেশ করেছিলেন।

রাকিব

আরো পড়ুন  

×