
ছবি: সংগৃহীত
আনুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে ভোট হলে স্থানীয় পর্যায়ে নেতা ও নেতৃত্ব তৈরি হবে না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘আনুপাতিক (পিআর) ভোট কেন? এটা আপনারা কীসের জন্য চান? তাহলে তো এলাকায় এলাকায় আর কেউ নেতা হতে পারবে না। কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে তো কেউ নেতা হতে পারবে না। একটা লোক তার একটা এলাকায় দীর্ঘ কাজ করছে, মানুষের সাথে তার যোগাযোগ হচ্ছে, আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। এসব কাজ করতে করতে ধীরে ধীরে নেতা হয়। যখন আনুপাতিক ভোটের বিষয়টি আসবে তখন তো মানুষ দলকে ভোট দিবে। তারপরে দল বেছে বেছে তার লোকদের এমপি বলে ঘোষণা করবে। এটি হলে দেশকে আরও বেশি স্বৈরশাসনের দিকে ঠেলে দেবে।’
বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রংপুরের গ্র্যান্ড হোটেল মোড়ে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে স্বেচ্ছায় রক্তদান ও ব্লাড গ্রুপিং কর্মসূচির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন তিনি।
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে শোক ও বিজয় কর্মসূচি পালন উপলক্ষে বিএনপির কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে স্বেচ্ছায় রক্তদান ও ব্লাড গ্রুপিং কর্মসূচির আয়োজন করে ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন রংপুর (ড্যাব)।
পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়িত হলে কী হবে তা তুলে ধরে রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘স্থানীয় পর্যায়ে আর কোনো নেতৃত্ব থাকবে না। স্থানীয় পর্যায়ে নিজেদেরকে গড়ে তুলে কেউ ক্যারিয়ার তৈরি করবে, সেটি থাকবে না। আমরা চেয়েছি চিরায়িত গণতন্ত্রের সেই ভোট, যারা বৈধ ভোটার তারা ভোট দিয়ে তার এলাকায় প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। যে দলের প্রতিনিধিরা সবচেয়ে বেশি ভোট পাবে তারা সরকার গঠন করবে। এই আঠারো কোটি মানুষের দেশে প্রায় ১২ কোটির মতো ভোটার, সেখানে আপনারা কীভাবে এই আনুপাতিক ভোটের কথা বলছেন, এটা তো আমরা বুঝতে পারছি না। যে গণতন্ত্রের জন্য মানুষ জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে, বছরের পর বছর কারাবরণ করেছে, সেই গণতন্ত্র আজ প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচন, গণতন্ত্র ও দেশের সার্বভোমত্বের প্রশ্নে বিএনপি কখনো আপোষ করেনি।’
তিনি আরও বলেন, জুলাই-আগস্ট এক ঐতিহাসিক এবং রক্তঝড়া আন্দোলন। এই আন্দোলন একচক্ষুবিশিষ্ট এক দানবকে বিদায় করেছে। সেই গৌরবোজ্জ্বল বিপ্লবকে স্মরণ করে বিএনপি জাতীয় গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে শোক ও বিজয় পালন করছে।
রুহুল কবির রিজভী আরও বলেন, ‘দুর্বিষহ দিন গেছে ১৬ বছর, কোনো তরুণ রাতে ঘুমাতে পারেনি। কোনো তরুণের পরিবার শান্তিতে থাকতে পারেনি। কার সন্তানকে কখন ধরে নিয়ে যাবে, কাকে অদৃশ্য করবে। কার রক্তাক্ত লাশ তিস্তা, শীতলক্ষ্যা, পদ্মা, বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে পড়ে থাকবে, তার নিশ্চয়তা ছিল না। হত্যা আর ঘাতকের সংকীর্ণ পথ দিয়েই আমাদেরকে ১৬ বছর পাড়ি দিতে হয়েছে। এই ভয়াবহ দুর্বিষহ দিনগুলোতে শেখ হাসিনার করাল গ্রাস থেকে কারো নিস্তার ছিল না। বিগত সরকারের ভয়াবহ বিষাক্ত থাবা থেকে এ দেশের গণতন্ত্রমনা মানুষের কেউই রেহাই পায়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই ১৬ বছরের নিরন্তন সংগ্রাম ও রক্তাক্ত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপি এগিয়ে চলেছে। তারপর আমরা দেখলাম ছাত্ররা নেমে আসলো। পুলিশের তাক করা গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনকে আত্মদান করলেন আবু সাঈদ। রংপুরের সেই আবু সাঈদের আত্মদানের মধ্যদিয়ে শুরু হয়ে গেল সারা বাংলাদেশে আন্দোলনের ঝড়। আমাদের কাছ থেকে আরো অনেক তরুণ ছাত্ররা হারিয়ে গেল। আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেল চট্টগ্রাম ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম। এই ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আসার কারণে শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হলো।’
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আবু সাঈদসহ শহীদদের আত্মদানকে স্মরণ করে বিএনপির সিনিয়র এই নেতা বলেন, ‘আমরা কী আবু সাঈদকে ভুলে যাবো? তার সেই বিরোচিত আত্মত্যাগ এবং তার এই আত্মদানকে নিয়েও সমালোচনা করেছে শেখ হাসিনা। বলেছিল সে (আবু সাঈদ) জঙ্গি, অন্য কারো গুলিতে সে মারা গেছে। সবাই দেখলো, কোন পুলিশ কীভাবে তাকে গুলি করেছে। এটাকে নিয়েও সে (শেখ হাসিনা) টিটকারি করেছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এই বাচ্চা ছেলের রক্ত ঝড়ছে, আপনি (শেখ হাসিনা) মা, একজন মহিলা আপনার হৃদয় কেঁদে উঠলো না। আপনি আপনার অবৈধ ক্ষমতা, লুটপাটের ক্ষমতা, ব্যাংক ডাকাতির ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ওই বাচ্চাদের রক্ত ঝড়াতে আপনি দ্বিধা করেননি।’
তিনি আরও বলেন, ‘গুম কমিশন দ্বিতীয় দফার রিপোর্ট দিয়েছে। ওই রিপোর্ট যদি পড়েন প্রত্যেকের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাবে। গুম করার জন্য ধরে নিয়ে আসতো এক অন্ধকার কক্ষে। তারপর প্রচণ্ড লাঠিপেটা করত। হাত পায়ের নখ তুলে দিতো। তারপরে কোথায় রাখতো তার কোনো ঠিকানা নেই। নারীদেরকেও ধরে নিয়ে আসতো। মায়ের সামনে মেয়ের ওড়না খুলে ফেলতো। আবার মেয়েকে দাঁড় করে রেখে তার মাকে নির্যাতন করতো। এই রক্তপিপাসুরা এবং তাদের সহযোগিরা যাতে আবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরতে আসতে না পারে সেজন্য গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য দরকার।’
রুহুল কবির রিজভী বলেন, গণতন্ত্র মানেই হচ্ছে আমরা একে অপরের বিরুদ্ধে মুক্তকণ্ঠে সমালোচনা-আলোচনা, ভিন্নমত প্রকাশ করব। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আমরা আমাদের ইস্যু নিয়ে কাজ করব। কিন্তু দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আমরা আবার পরস্পরকে সহযোগিতা করব। এটাই তো নিয়ম। যে গণতন্ত্রের জন্য এত লড়াই, যে গণতন্ত্রের আবু সাঈদ, ওয়াসিম, মুগ্ধ, ফাইয়াজ জীবন দিয়েছে। প্রায় চৌদ্দশো থেকে পনেরোশো সন্তান জীবন দিলো। রিকশাওয়ালা ২৩ জন মারা গেছে। শ্রমিক প্রায় ১৫০ জন মারা গেছে শেখ হাসিনার পেটুয়াবাহিনী আর বুলেটের আঘাতে। আমরা তো চাই প্রকৃত গণতন্ত্র।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে রিজভী বলেন, চাঁদাবাজি, দখলবাজির সঙ্গে বিএনপির কোনো অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের জড়ানো চলবে না। বিএনপির নেতাকর্মীদের আচরণে যেন সাধারণ মানুষ কষ্ট না পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষ যেন বিএনপির কাছ থেকে ন্যায়বিচার পায়, সেই বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। কেউ যদি এসব অপকর্মে জড়িত থাকে, দল সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে-এ বিষয়ে কোনো ছাড় নেই।
এ সময় ড্যাবের রংপুর মহানগরের আহ্বায়ক ডা. নিখিলেন্দ্র শংকর গুহের সভাপতিত্বে উপস্থিত ছিলেন রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মাহফুজ উন নবী ডন, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক শহিদুল ইসলাম মিজু, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-সভাপতি ডা. জাহিদুল কবির, কেন্দ্রীয় ছাত্রদল সহ-সভাপতি ডা. তৌহিদুর রহমান আউয়াল, মহানগর যুবদলের আহ্বায়ক নুরুন্নবী চৌধুরী মিলন, রংপুর জেলা যুবদলের সভাপতি নাজমুল আলম নাজু, ড্যাবের রংপুর জেলা আহ্বায়ক ডা. খালেকুজ্জামান বাদল, রংপুর মেডিকেল কলেজ শাখা ড্যাবের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মাহমুদুল হক সরকার, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. শরীফুল ইসলাম মন্ডল প্রমুখ।
রাকিব