ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৪ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

এক উঠানে মাদ্রাসা ও আশ্রম, মুরাদনগরে ধর্মীয় সম্প্রীতির ৪০ বছরের বন্ধন

মোহাম্মদ শরিফুল আলম চৌধুরী, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, কুমিল্লা

প্রকাশিত: ০০:৩৩, ৪ জুলাই ২০২৫

এক উঠানে মাদ্রাসা ও আশ্রম, মুরাদনগরে ধর্মীয় সম্প্রীতির ৪০ বছরের বন্ধন

ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ।

যেখানে ধর্ম নিয়ে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়, সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি হয়—সেখানে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে মানবতার এক আশ্রয়স্থল, যেখানে শুধু বিশ্বাস নয়, শেকড় গেড়েছে সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর অকৃত্রিম ভালোবাসা।

এক পাশে মুসলিম শিশুদের কোরআন তেলাওয়াতের মধুর ধ্বনি, আর অন্য পাশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনার ঘণ্টাধ্বনি। দেয়াল একটি, কিন্তু হৃদয়ের মাঝে কোনো দেয়াল নেই। এ যেন কাজী নজরুল ইসলামের সেই কবিতার জীবন্ত রূপ—“মোরা এক বৃন্তে দুই কুসুম হিন্দু মুসলমান, মুসলিম তার নয়ন মণি হিন্দু তাহার প্রাণ।”

মুরাদনগরের নবীপুর পশ্চিম ইউনিয়নে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে দুইটি প্রতিষ্ঠান—রহিমপুর হেজাজীয়া এতিমখানা ও হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও সনাতন ধর্মের অযাচক আশ্রম।

চার দশক ধরে এ দুটি প্রতিষ্ঠান একই আকাশের নিচে, একই উঠানে—অভিন্ন মাটিতে গড়ে তুলেছে সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত। শুধু মুখে নয়, কাজেও প্রমাণ করে চলেছে, ধর্ম মানুষকে আলাদা করে না, বরং মানুষের কল্যাণে একসাথে চলার পথ দেখায়।

দুই ধর্ম, এক হৃদয়- ১৯৩১ সালে অখণ্ডমণ্ডলেশ্বর শ্রীমৎ স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব প্রতিষ্ঠা করেন অযাচক আশ্রম। আর ঠিক তার পেছনেই, ১৯৮৬ সালে মাত্র ১০ জন এতিম ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করে হেজাজীয়া মাদ্রাসা। আজ সেখানে ছাত্র সংখ্যা ৩৫০, ১৬ জন শিক্ষক, ৪ জন বাবুর্চি আর একজন অফিস সহকারী দায়িত্ব পালন করছেন।
দেয়াল একটিই, কিন্তু দেয়ালের দুই পাশে নেই কোনো দ্বন্দ্ব, নেই হিংসা, নেই বিদ্বেষ। আছে কেবল আস্থা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সৌহার্দ্য।

সন্ধ্যায় যখন মসজিদে আজান হয়, মন্দিরে থেমে যায় পূজার ঢাক। আর হিন্দু ধর্মের ‘আগমনি উৎসবের’ সময় মাদ্রাসা তাদের মাহফিল পিছিয়ে দেয় সম্মানের খাতিরে। আশ্রমের অধ্যক্ষ ডা. মানবেন্দ্র নাথ সরকারের কণ্ঠে শোনা যায় গর্বের সুর—“আমাদের সীমানার দেয়ালের ওপাশে মসজিদ, কিন্তু কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। বরং তারা আমাদের উৎসবে নিরাপত্তা দেয়, সহযোগিতা করে। এই সহনশীলতাই তো ধর্মের শিক্ষা।”

মাদ্রাসার পরিচালক কাজী লোকমান বলেন, “আশ্রম কর্তৃপক্ষ পূজার আগে আমাকে চিঠি দিয়ে দাওয়াত দেয়, আমিও আমার মাহফিলে তাকে দাওয়াত দিই। আল্লাহ ও রাসূল (সা.) অন্য ধর্মের অনুসারীদের জানমাল রক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই এই সম্প্রীতি রক্ষা করা আমাদের ঈমানের অংশ।”

ধর্ম নয়, মানুষই মুখ্য- এই দুটি প্রতিষ্ঠানের গল্প নিছক সহাবস্থানের নয়—এটি একটি আদর্শ সমাজ গড়ার ভিত্তি, যেখানে ধর্মের ব্যবধান ছাপিয়ে মানুষই মানুষের পাশে থাকে। এই মানবিক সৌন্দর্যই মুরাদনগরের গর্ব।

শতবর্ষী আশ্রমের অধ্যক্ষ ডা. মানবেন্দ্র নাথ সরকার শুধু ধর্মীয় নেতা নন, মানবসেবার এক জীবন্ত প্রতীক। বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়ে তিনি এ পর্যন্ত ৫ লাখেরও বেশি মানুষকে সেবা দিয়েছেন। অপরদিকে, মাদ্রাসার পরিচালক কাজী লোকমান শুধু শিক্ষক নন, তিনি নিজেই সম্প্রীতির এক ‘জীবন্ত মিনার’।

সিনিয়র সাংবাদিক মো. হাবিবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, “দেয়াল শুধু সীমানা টানে, সম্পর্ক নয়। আশ্রম আর মাদ্রাসার এই সম্পর্ক আমাদের বুঝিয়ে দেয়—সম্প্রীতি মানেই একে অন্যের প্রতি দায়িত্ব ও ভালোবাসা।”

মুরাদনগরের এই সম্প্রীতির গ্রাম যেন বাংলাদেশের গর্ব। দেশজুড়ে যখন ধর্মের নামে রক্ত ঝরে, তখন এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে চার দশকের ভ্রাতৃত্ব, তা যেন আলেয়ার মতো পথ দেখায়। এখানে ধর্ম কোনো দেয়াল নয়—একটি সেতু। এক ধর্মের উৎসবে আরেক ধর্মের মানুষের হাসিমুখে সহায়তা, একে অপরকে দাওয়াত, সমন্বয়, শ্রদ্ধা—এই বাংলাদেশকে দেখার মতো।

মিরাজ খান

×