
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দেওয়ালে দৃশ্যমান গ্রাফিতিতে ফুটে উঠেছে জুলাই অভ্যুত্থানের উত্তাল সময়ের চিত্র
শহর ঢাকার দেওয়ালগুলোয় এখনো সেঁটে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন নানা গ্রাফিতি। রাজধানীর নানা প্রান্তের দেওয়ালে চোখ ফেললেই ধরা দেবে দেওয়ালে আঁকা ছবি থেকে দেওয়াল লিখন। আর এসব গ্রাফিতির মাঝে মিশে আছে দ্রোহের উত্তাপ থেকে স্বপ্নের স্বদেশ বিনির্মাণের আকাক্সক্ষা। কোনোটি আবার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার বারতা দেয়। ভয়কে জয় করে শৃঙ্খল ভেঙে দুঃশাসন থেকে মুক্তির ইশারা দেয়। আর সেই দেওয়ালচিত্রগুলো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে বছর ঘুরে আবার এসেছে ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মাস জুলাই।
গত বছর জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালে প্রতিবাদের স্বতঃস্ফূর্ত ¯্রােতধারায় চিত্রিত হয়েছিল এসব গ্রাফিতি। রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক, খুঁটি ও দেওয়ালে শিক্ষার্থীদের আঁকা দেওয়ালচিত্রসমূহ সরকার পতনের শিল্পিত হাতিয়াররূপে আবির্ভূত হয়েছিল।
বৃহস্পতিবার নজর পড়ে পুরান ঢাকার কেএম দাস লেনের একটি বাড়ির দেওয়ালে। লাল, নীল. সবুজ, কালোসহ নানা রঙের আঁচড়ে দেওয়ালটি রূপ নিয়েছে ভাসমান ক্যানভাসে। কংক্রিটের সেই চিত্রপটে সূর্যের ভেতর থেকে দৃশ্যমান হয়েছে বাংলাদেশের পতাকায় আবৃত একটি মুষ্টিবদ্ধ হাত। ওই হাতের এক পাশে যুক্ত হয়েছে মসজিদ এবং অপর পাশে মন্দিরের ছবি। ওপরের অংশে লেখা ‘ধর্ম যার যার, দেশ সবার’ বাক্যটিতে মূর্ত হয়েছে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ার আকাক্সক্ষা।
অভ্যুত্থানকালে চিত্রিত গ্রাফিতির সন্ধানে পুরান ঢাকা পেরিয়ে ঢুঁ দেই আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায়। শাহবাগ থেকে শহীদ মিনার হয়ে ফুলার রোডের বিস্তৃত পরিসরজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অজ¯্র গ্রাফিতি। চলতি পথের পথিকদের কেউ কেউ দেওয়ালে উৎকীর্ণ ছবি বা লেখা দেখে স্মরণ করছেন আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ সময়কে। তেমনই এক গ্রাফিতিতে রিক্সার পাদানিতে সটানভাবে ঝুলে আছে পুলিশের গুলিতে আহত এক শিক্ষার্থী। মাথায় পতাকা বাঁধা ওই শিক্ষার্থীর পা জোড়ার ঠাঁই পাদানিতে, ঝুলে পড়েছে সড়কের পানে।
রিক্সাচালক সজোরে প্যাডেল চালিয়ে আহত শিক্ষার্থীকে নিয়ে ছুঁটেছে কোনো হাসপাতাল কিংবা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। টিএসসির পেছনের কালো রঙের দেওয়ালে মিছিলের দৃশ্যকল্পের সঙ্গে লাল রঙের আভায় চমৎকারভাবে লেখা হয়েছে ‘৩৬শে জুলাই’ শব্দটি। ফুলার রোডের একটি দেওয়ালে পুলিশি দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে জ্বলে তিন সংগ্রামী নারীর দেখা মেলে। আত্মরক্ষায় তারা হাতে তুলে নিয়েছে দা-বঁটি। প্রতিরোধের প্রতিচ্ছবিময় সেই দৃশ্যের নিচে লেখা ‘বাংলার মায়েরা মেয়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা’।
পাশের দেওয়ালচিত্রে রাজু ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে উপস্থাপিত হয়েছে খ-খ- দৃশ্যকল্প। আন্দোলনে সরকারি পেটোয়া বাহিনীর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যেন লজ্জায় লাল কাপড়ে ঢেকে গেছে ভাস্কর্যের অবয়বসমূহের চোখগুলো। এর মধ্যে একটি অবয়বের হাতে ঝুলছে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার আগে মীর মুগ্ধর বলা হৃদয়ে হাহাকার তোলা সেই বাক্যটি ‘পানি লাগবে পানি?’
একটি দৃশ্যে হামলায় আহত এক ছাত্রীকে কোলে তুলে নিয়ে নিরাপদ গন্তব্যে ছুটছে এক ছাত্র। ওই ছাত্রের মাথার ওপর দিয়ে উড়ছে শৃঙ্খল ভেঙে মুক্তির পথ দেখানো একজোড়া পায়রা। একটি দেওয়ালচিত্রে মেলে ধরা হয়েছে শহীদ আবু সাঈদের বোনের বেদনার্ত উক্তি। টেলিভিনের মাইক্রোফোনের সামনে আবু সাঈদের বোন বলছে, ‘আমার ভাইয়ের একটা হাত ভাইঙ্গে ফালাইতো, একটা পা ভাইঙ্গে ফালাইতো, চারটে গুলি মারলো কেন?’ এসব দেওয়ালচিত্রের মাঝে নজর কেড়ে নেয় একটি দেওয়ালচিত্র। লাল-সবুজ ও কালো হরফে সেখানে লেখা ‘স্বৈরাচারের রাইফেলের সামনে বুক প্রশস্ত করে দাঁড়িয়ে থাকা আবু সাঈদরাই বাংলাদেশ।’
এসব দেখতে দেখতে চোখ চলে যায় সাদা-কালো রঙের আঁচড়ে উদ্ভাসিত একটি দেওয়ালচিত্রে। অর্থবহ ওই গ্রাফিতিতে খাঁচা থেকে বেরিয়ে অসীম অন্তরীক্ষের পানে উড়াল দিচ্ছে একটি পাখি। এই ছবির পাশেই লেখা ‘রিবার্থ থার্টিসিক্স জুলাই’।
এভাবেই শহরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অগণন গ্রাফিতি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে জুলাই অভ্যুত্থানের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার মাঝেও পুনরায় সামনে আসছে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের আকাক্সক্ষার কথা। পুনরায় মনে করিয়ে দিচ্ছে সকল অন্যায় ও অসাম্য দূর করে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়ার অঙ্গীকার। স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে জাতি-ধর্ম-বর্ণের বিভেদ পেরিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ার কথা। গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-শিক্ষক, আমজনতা থেকে রাজনীতিবিদদের সম্মিলিত আকাক্সক্ষাই কেবল পূরণ করতে পারে সেই স্বপ্ন।