
ছবি: সংগৃহীত
আমার বাবা মো. হাবিব—পেশায় একজন গরুর গোশতের ব্যবসায়ী। কিন্তু তাঁর পরিচয় কি শুধু এতটুকু? আমার কাছে তিনি ছিলেন আমার প্রথম পাঠশালা, জীবনের প্রথম শিক্ষাগুরু, সাহস আর সত্য বলার প্রথম অনুপ্রেরণা।
যখন আমার বয়স ৭-৮ বছর, স্কুল থেকে ফিরেই ছুটে যেতাম বাবার দোকানে। চারদিকে কাঁচা গোশতের গন্ধ, ঠুনঠুনে পাল্লার শব্দ, আর বাবার কণ্ঠের দৃঢ়তা—সব মিলিয়ে যেন এক জীবন্ত কর্মশালায় আমি বেড়ে উঠেছি। অন্য কারও কাছে হয়তো এটা ছিল একটা সাধারণ কসাইয়ের দোকান, কিন্তু আমার কাছে ওটাই ছিল জীবনের প্রথম নিউজরুম—যেখানে প্রতিদিন মানুষের মুখ, ভাষা আর ভেতরের সত্য চিনতে শিখেছি।
বাবার দোকানে গিয়ে আমি কখনো খালি হাতে ফিরিনি—কখনো হাতে মাছ-মাংস, কখনো বাবার গল্প। তিনি বলতেন, “মানুষের পেটের ব্যবসা করতেছি, তাই মনেও কিছু রাখতে হয়। কেউ যাতে ঠকিয়ে না যায়, আবার কেউ যাতে খালি হাতে না যায়।”
এই শিক্ষা আমার জীবনের ভিত গড়েছে। যখন সাংবাদিকতা শুরু করি, তখন অনেকেই বলেছিল—‘তোর তো মিডিয়ার লোক ছিল না, তুই কেমনে প্রবেশ করলি?’ আমি হেসে বলতাম—আমার বাবার হাঁড়ির নিচে আগুন যেমন টিকিয়ে রাখত রান্না, ঠিক তেমনই তাঁর সাহস আর সততা টিকিয়ে রেখেছে আমার ভিতরের আগুন।
বাবা কখনো আমাকে বলেননি ‘তুই সাংবাদিক হ’, তিনি শুধু বলতেন—“ভালো মানুষ হ, অন্যায় সহ্য করিস না।” এই কথাগুলোর ভিতরেই লুকানো ছিল তাঁর অদৃশ্য সাংবাদিকতা, তাঁর জীবনবোধ।
বাবার আদরে শাসনে গড়া আমার ভিতরের আমি আমার লেখাপড়ার খরচ, এমনকি প্রথম মুঠোফোন কেনার টাকাটাও জোগাড় করেছিলেন সেই দোকানের লাভ থেকে। অথচ নিজের জন্য কখনো এক জোড়া নতুন জুতা কেনেননি। ঈদের সময় আমার নতুন জামা কিনে নিজে পরতেন পুরনো লুঙ্গি। আমি সেই ছোটবেলায় বুঝিনি কেন, কিন্তু বড় হয়ে বুঝেছি—বাবারা এমনই হয়।
আর শাসনের কথা? একবার স্কুল পালিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। বাড়ি ফিরতেই বাবা কিছু না বলে একবার কড়া চোখে তাকিয়ে ছিলেন। সেদিন কোনও বকুনি বা মার খাইনি, কিন্তু বাবার সেই চাহনি আজও আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সতর্কবাণী। সেই চাহনির ভেতরে ছিল ভরসা, দায়িত্ব, আর সীমারেখা বোঝানোর এক দারুণ শিক্ষা।
আজ আমি নিজেও একজন বাবা। আমার ছোট ছেলেটা যখন জিজ্ঞেস করে, “বাবা, তুমি ছোট থাকতে কী হতে চাইতে?”, আমি চুপ করে থাকি। কারণ আমি ছোটবেলায় কোনো কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখিনি—আমি শুধু বাবার মতো হতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু এখন যখন আয়নার সামনে দাঁড়াই, বুঝি—বাবার মতো মানুষ হওয়া খুব কঠিন। আমি হয়তো শহরের একজন সাংবাদিক, মানুষ আমাকে চিনে, সম্মান দেয়। কিন্তু আজও যখন বাবার দোকানে গিয়ে বসি, মনে হয়—এইটুকু মানুষই আমার আসল পরিচয়।
বাবা দিবসে বাবার প্রতি আমার লেখা এই চিঠি
বাবা, আপনি হয়তো কোনোদিন বলতে পারেননি, “আমি তোমাকে ভালোবাসি।” কিন্তু প্রতিদিন আপনার হাতে আমার স্কুলের খাতা ধরিয়ে দেওয়া, পকেটে ভরে দেওয়া পয়সা, কিংবা দোকানে পাশে বসিয়ে রাখা—এই সব কিছুই তো আপনার ভালবাসার ভাষা ছিল। আমি আজ যা কিছু, তার পেছনে আপনার রাতজাগা শ্রম, ঈদের সময় নিজের খরচ বাঁচিয়ে আমার নতুন জামা কেনা, আর জীবনভর সৎভাবে বাঁচার শিক্ষা।
আজ বাবা দিবস, অথচ আমার জন্য প্রতিদিনই “বাবার দিন”। কারণ প্রতিদিন আমি যেটুকু ভালো কাজ করি, সেটুকুই তো আপনাকে বাঁচিয়ে রাখে আমার ভেতর।
এই লেখা আমার বাবাকে উৎসর্গ করছি। যাঁর হাতের গন্ধ ছিল কাঁচা মাংসের, কিন্তু হৃদয়ে ছিল সুবাসিত পবিত্রতা। তিনি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ছিলেন না, ছিলেন না কোনো নামকরা নেতা, কিন্তু আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা—আমার বাবা।