ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৫ মে ২০২৫, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

দক্ষিণ এশিয়ার চলমান অস্থিরতায় কবি নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা

মেহেদী কাউসার

প্রকাশিত: ১৮:৩৬, ২৫ মে ২০২৫

দক্ষিণ এশিয়ার চলমান অস্থিরতায় কবি নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা

ছ‌বি: সংগৃহীত

দক্ষিণ এশিয়া— বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ, সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময় এবং ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। কিন্তু এই অঞ্চলটি বিগত কয়েক দশক ধরেই রাজনৈতিক অস্থিরতা, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, চরমপন্থা, দারিদ্র্য ও বৈষম্যের কঠিন বাস্তবতায় জর্জরিত। একদিকে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার, অন্যদিকে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার দুর্নীতি ও বৈষম্য এই জনপদের স্বপ্নগুলোকে প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। এমন এক সংকটকালে কাজী নজরুল ইসলামের আদর্শ, সাহিত্য ও দৃষ্টিভঙ্গি যেন আলোর মশাল হাতে দাঁড়িয়ে থাকে পথ দেখানোর জন্য।

কাজী নজরুল ইসলাম শুধু একজন কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিপ্লবের সুরকার, সাম্যের সাধক এবং মানবতার পূজারী। তাঁর কাব্য, সংগীত ও প্রবন্ধসমূহে বারবার ফিরে আসে মানুষের মুক্তি, জাতিগত সম্প্রীতি, ও সামাজিক ন্যায়ের কথা। তিনি লিখেছিলেন— ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা মানুষে মানুষে দেয় দেয়াল তুলে, আমি সেই ধর্মকে মানি না। এই উচ্চারণ এক শতাব্দী আগেও যেমন প্রয়োজন ছিল, আজকের দক্ষিণ এশিয়ায় তা আরও প্রয়োজনীয়।

ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা শ্রীলঙ্কা— সব দেশেই বর্তমানে ধর্মীয় ও জাতিগত সহিংসতা, রাজনৈতিক হিংস্রতা এবং সামাজিক বিভাজন গভীরভাবে প্রোথিত। এমন সময় নজরুলের লেখা যেন এক প্রতিরোধের ভাষা। তিনি ছিলেন হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান— সব সম্প্রদায়ের সংহতির কথা বলার অগ্রপথিক। তাঁর বিখ্যাত কবিতা "মানুষ"–এ তিনি লিখেছেন:
"গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্‌লিম-ক্রীশ্চান।"

এই চেতনা শুধু সাহিত্যিক সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ নয়, এটি ছিল তৎকালীন উপমহাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এক বৈপ্লবিক ঘোষণা।

নজরুলের সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা “বিদ্রোহী” তাকে দিয়েছে চিরকালীন বিপ্লবের প্রতীকী পরিচিতি। সেখানে তিনি বলেন—
"আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন।"

এই বিদ্রোহী সত্তা কেবল ঔপনিবেশিক শাসন কিংবা সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল সমস্ত অন্যায়, বৈষম্য, নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে এক অনমনীয় অবস্থান।

দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমরা দেখতে পাই— নির্বাচিত সরকারগুলো অনেক সময়ই জনস্বার্থ নয়, বরং ক্ষমতাসীনদের সুবিধা রক্ষায় ব্যস্ত থাকে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব হয়, বিরোধী মতকে দমন করা হয়, সংখ্যালঘুদের উপর হামলা হয় বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে। এসব পরিস্থিতিতে নজরুলের বিদ্রোহী চেতনা আজও আমাদের সাহস জোগায়। তাঁর কণ্ঠ বলছে— নিপীড়িতের পাশে দাঁড়াও, শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলো, দমন-পীড়নকে ভয় না পেয়ে প্রতিবাদ করো।

নজরুল এমন এক সময় জন্মগ্রহণ করেন এবং সাহিত্যচর্চা করেন যখন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন চলছিল এবং হিন্দু-মুসলিম বিভাজন রাজনীতির কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন—
"অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!"

এই মানবতাবাদী দর্শন আজকের দিনে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। ভারতে যখন ধর্মীয় মেরুকরণ, গোরক্ষা আন্দোলন বা লাভ জিহাদের মতো বিষাক্ত প্রচারণা চলে, পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননার নামে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা ঘটে, কিংবা বাংলাদেশে পূজামণ্ডপে হামলা হয়, তখন নজরুল যেন নতুন করে আমাদের মনে করিয়ে দেন— আমরা প্রথমে মানুষ, পরে অন্য কিছু।

নজরুল ছিলেন নারী স্বাধীনতার এক অকুতোভয় প্রবক্তা। তিনি বলেছেন—
"বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।"

আজকের দক্ষিণ এশিয়ায়, যেখানে বাল্যবিয়ে, যৌন নিপীড়ন, নারীকে ঘরের চার দেয়ালে বন্দি রাখার প্রবণতা এখনও রয়ে গেছে, সেখানে নজরুলের এই নারীনির্ভর মানবতাবাদ নতুন আশার আলো দেখায়। তিনি শুধু কবিতায় নয়, বাস্তব জীবনেও নারীর মর্যাদা ও স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। তাঁর স্ত্রী প্রমীলা যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, তিনি নিজ হাতে তাঁর সেবা করেছেন, যা সে সময়কার পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ব্যতিক্রম ছিল।

দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এ অঞ্চলের বিশাল যুবসমাজ। কিন্তু এই তরুণরা আজ বেকারত্ব, মাদক, হতাশা এবং রাজনৈতিক ব্যবহারিত হওয়ার শিকার। নজরুল এই তরুণদের উদ্দেশে বলেছিলেন—
"চল-চল-চল!
ঊর্ধ্ব-গগনে বাজে মাদল, নিম্নে উতলা ধরণি-তল,
অরুণ প্রাতের তরুণ দল, চল রে চল রে চল।
চল-চল-চল!"

তরুণদের মধ্যে নৈতিক শক্তি, প্রতিবাদী মানসিকতা, ও সৃজনশীল সাহস জাগিয়ে তোলার মতো সাহিত্যিক শক্তি নজরুল ছাড়া আর খুব কম কবির মধ্যে দেখা যায়।

নজরুলের চিন্তাধারা আজ শুধু সাহিত্যিক আলোচনার বিষয় নয়, এটি একটি জীবনচর্চার দর্শন। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত, সবাই যদি নজরুলের মতো অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, সাম্যবাদী চেতনা ধারণ করে, তবে দক্ষিণ এশিয়ার বহু সমস্যার সমাধান সহজতর হতে পারে। তিনি আমাদের শেখান কিভাবে ধর্মকে ব্যক্তিগত ও মানবিক পর্যায়ে রাখা যায়, কিভাবে জাতিকে ভালোবেসে বিদ্রোহ করা যায়, কিভাবে নারীকে পূর্ণ সম্মান দিয়ে সমাজকে উন্নত করা যায়।

দক্ষিণ এশিয়ার চলমান সংকটের ভেতরে কাজী নজরুল ইসলামের আদর্শ এক নতুন রাজনৈতিক-সামাজিক চেতনার বীজ বপন করতে পারে। তাঁর সাহিত্য শুধু অতীতের গৌরব নয়, বরং বর্তমানের প্রয়োজন এবং ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ। নজরুল আজও বেঁচে আছেন, আমাদের অন্তর্দৃষ্টি ও বিবেকের ভেতর। যখনই অন্যায়, বৈষম্য বা বিভেদ আমাদের সমাজে মাথা তোলে, তখনই নজরুলের বিদ্রোহী কণ্ঠস্বর যেন ফিরে আসে আমাদের দিকনির্দেশ দিতে—

"আমি চিরবিদ্রোহী বীর—
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!"

লেখক: সাংবাদিক

এম.কে.

×