ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৫ মে ২০২৫, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ

কোথায় আশ্বাস কোথায় আশঙ্কা

ড. জাহাঙ্গীর আলম সরকার

প্রকাশিত: ১৯:২২, ২৫ মে ২০২৫

কোথায় আশ্বাস কোথায় আশঙ্কা

২০২৫ সালের ২১ মে। বাংলাদেশে অন্তর্র্বর্তী সরকার এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ নামে একটি নতুন আইন প্রবর্তন করে। এই অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় পূর্ববর্তী ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’। মাত্র দুই বছর আগেই এই আইনটি প্রণয়ন করে বিগত সরকার বলেছিল, এটি হবে বিতর্কিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮’-এর মানবাধিকার-সহন সংস্করণ। তাতে বলা হয়েছিল, এই আইন হবে নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গোপনীয়তা ও ডিজিটাল নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষাকারী একটি আধুনিক আইন। কিন্তু বাস্তব চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ ছিল অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা না নেওয়ার এক নির্মম স্মারক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ছায়া থেকে মুক্তি দেওয়ার বদলে সেটির অধিকতর কঠোর সংস্করণ হিসেবে আবির্ভূত হয় এই আইন। এর মাধ্যমে সরকারের সমালোচক, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, এমনকি সাধারণ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরাও এক ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হন। বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার, এমনকি কৌতুক কিংবা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের স্বাধীনতাও যেন এক অদৃশ্য সেন্সরশিপের আওতায় চলে আসে।
এই প্রেক্ষাপটে ২০২৫ সালের ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ’ এসেছে পূর্ববর্তী আইনের ত্রুটিগুলো সংশোধনের দাবিতে। যদিও ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ এর অপপ্রয়োগ, বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ও মত প্রকাশের অধিকারে হস্তক্ষেপের দায় সরকার নিজেই স্বীকার করে তা বাতিল করে। কিন্তু নতুন অধ্যাদেশেও পুলিশের বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা বহাল রাখা, কিছু অপরাধে বিচার ও শাস্তির অমানবিকতা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (অও) সম্পর্কিত অপরাধে অনিশ্চিত সংজ্ঞা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব- নতুন অধ্যাদেশটি আসলে পূর্ববর্তী আইনের কতটা সংশোধন, কতটা পুনরাবৃত্তি? এটি কি আদতেই একটি গণতান্ত্রিক, মানবাধিকার সংরক্ষণকারী আইন, নাকি প্রযুক্তিনির্ভর শাসনের আরেকটি রূপ? একই সঙ্গে আলোচনা করব- এআই-নির্ভর অপরাধ দমন, ডিজিটাল নাগরিক অধিকার এবং বিচারিক নিশ্চয়তার বাস্তবচিত্র।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (২০২৩) রিপোর্ট অনুযায়ী, ওই আইনে প্রায় ৪২০০ মামলা হয়েছে, যার প্রায় ৭০ শতাংশেই ভুক্তভোগী ছিলেন সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, কিংবা ভিন্নমত পোষণকারী নাগরিক। নতুন অধ্যাদেশে পূর্ববর্তী আইনের কিছু বিতর্কিত ধারা বাতিল করা হয়েছে, যেমন ২১, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩১ ও ৩৪ ধারা। এসব ধারায় মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, জাতীয় প্রতীক ও ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে মত প্রকাশ, মানহানি এবং তথাকথিত ‘নেটওয়ার্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি’-র অপরাধে কঠোর শাস্তির বিধান ছিল। এই ধারাগুলোর বাতিল নতুন অধ্যাদেশের একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে ধরা যায়।

সন্দেহভিত্তিক গ্রেপ্তার ও মৌলিক অধিকার

যদিও বিতর্কিত কিছু ধারা বাতিল হয়েছে, অধ্যাদেশের ৩৫(ঘ) ধারায় পুলিশকে ‘সন্দেহের’ ভিত্তিতে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই ধারা মৌলিক অধিকার পরিপন্থি। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে এবং বিচারিক অনুমতি ব্যতীত আটক রাখা যাবে না। তাছাড়া, ইখঅঝঞ া. ইধহমষধফবংয (ডৎরঃ চবঃরঃরড়হ ঘড়. ৩৮০৬ ড়ভ ১৯৯৮) মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ সাফ জানিয়ে দেয়, বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার শুধু বিশেষ পরিস্থিতিতেই গ্রহণযোগ্য, তাও নিরপেক্ষ বিচারিক পর্যালোচনার মাধ্যমে। এই ধারা যদি রাজনৈতিক বা মত প্রকাশের দমনমূলক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তবে এটি ১৯৭২ সালের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৯ (১) ও (২)-এ বর্ণিত বাকস্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতার স্পষ্ট লঙ্ঘন। উক্ত অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্স্বাধীনতা সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্রচারণা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং সংবাদক্ষেত্রের নিশ্চয়তা দান করা হইল।’

এআই প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তি ॥ একটি
যুগান্তকারী সংযোজন

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে যদি কেউ বেআইনিভাবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোয় প্রবেশ বা ক্ষতিসাধন করে, তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে ডেটা সুরক্ষা আইন এখনো কার্যকর হয়নি সেখানে এআই ব্যবহারে অপরাধ প্রতিরোধে এই সংযোজন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ইউনেস্কোর ২০২৪ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় এআই ব্যবহার করে সংঘটিত সাইবার অপরাধের সংখ্যা গত দুই বছরে ৩৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিকভাবেও ইতিবাচকভাবে বিবেচিত হতে পারে।

বিচারাধীন মামলার বিলুপ্তি ॥ আইনগত ধোঁয়াশা

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর ৫০(৪) ধারায় বলা হয়েছে, পূর্ববর্তী আইন অনুযায়ী বিচারাধীন বা তদন্তাধীন মামলা, এমনকি যেগুলোর রায় ঘোষিত হয়েছে সবই বাতিল বলে গণ্য হবে। একদিকে এটি ভুক্তভোগীদের জন্য স্বস্তিকর। কারণ অনেক মামলাই ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কিন্তু অন্যদিকে, এটি সংবিধানের ১০৯ অনুসারে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ করে। আদালতসমূহের ওপর তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘হাইকোর্ট বিভাগের অধঃস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর উক্ত বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ থাকিবে।’ রাষ্ট্র বনাম জাহাঙ্গীর আলম (২০২১) মামলায় সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করেছিলেন, ‘একবার আদালত রায় দিলে তা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত দ্বারা বাতিলযোগ্য নয়।’ এমন বাস্তবতায়, অধ্যাদেশে বিচারিক রায় বিলুপ্তির বিধান ংবঢ়ধৎধঃরড়হ ড়ভ ঢ়ড়বিৎ-এর নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে হতে পারে।

অনলাইন জুয়া ॥ প্রথমবারের মতো
আইনগত সংজ্ঞায়ন

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হলো অনলাইন জুয়াকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা। ২০ নম্বর ধারায় অনলাইন জুয়া পরিচালনা, খেলা, প্রচার বা সহায়তার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। দেশে বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার অনলাইন জুয়া লেনদেন হয়, যার অধিকাংশই মোবাইল আর্থিক সেবার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এটি দেশের যুব সমাজকে আসক্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। ফলে, এই বিধান সময়োপযোগী।
তথ্যের অধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর ৪৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সংবাদমাধ্যম কর্মী বা নাগরিক তদন্ত বা অনুসন্ধান করতে গিয়ে ভুল তথ্য প্রকাশ করলে তা শুধু ‘উৎসের ভুল’-এর কারণে হলে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না। এটি সাংবাদিকদের জন্য স্বস্তির। ২০২১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত উরমরঃধষ জরমযঃং ধহফ গবফরধ ঈড়হভবৎবহপব-এ সাংবাদিকদের ৭৮ শতাংশ জানিয়েছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয়ে তারা অনেক প্রতিবেদন প্রকাশে বিরত থাকেন। তবে নতুন অধ্যাদেশে এই আশ্বাস দিলেও, মাঠপর্যায়ে পুলিশি হয়রানি বন্ধ করতে না পারলে এটি কার্যকর নীতিমালা হিসেবে বিবেচিত হবে না।

ভবিষ্যৎ করণীয়

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫ নিঃসন্দেহে কিছু ইতিবাচক দিক এনেছে। বিশেষ করে এআই প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্তি, জুয়া নিরোধ, বিতর্কিত ধারার বিলুপ্তি এবং সাংবাদিকদের জন্য কিছু সুরক্ষা ব্যবস্থা। তবে সন্দেহভিত্তিক গ্রেপ্তার এবং বিচারাধীন মামলা বিলুপ্তির মতো বিষয়গুলো এখনো উদ্বেগজনক। এই আইনের সঠিক ও ন্যায়সংগত প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হলে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা উচিত-
১. নিরপেক্ষ ও স্বাধীন সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন, যেখানে গ্রেপ্তার ও তদন্তের ন্যায্যতা নিয়মিত বিচারিক পর্যালোচনার আওতায় আসবে।
২. ডেটা সুরক্ষা আইন দ্রুত প্রণয়ন করে নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
৩. সাইবার অপরাধে এআই ব্যবহারের ট্র্যাকিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি।
৪. মানবাধিকার কমিশনের কার্যকরী পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা।
বাংলাদেশ একটি ‘ডিজিটাল রাষ্ট্র’ গঠনের পথে। এ পথে চলতে গিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও মানবাধিকার এই তিনটি স্তম্ভকে সমান্তরালে গুরুত্ব দিতে হবে। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫ সে পথে একটি পদক্ষেপ- তবে সেটি যেন গণতন্ত্রের ভিত না দুর্বল করে, সেটিই এখন সময়ের দাবি।

 লেখক : আইনজীবী ও গবেষক

প্যানেল

×