
সামনে ঈদুল আজহা, কুরবানির ঈদ। এর প্রধান আনুষ্ঠানিকতা পশু জবাই। বাংলাদেশে সারা বছর যত পশু জবাই হয় তার প্রায় অর্ধেক জবাই হয় কোরবানির ঈদে। গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের কোরবানির ঈদে জবাই করা হয়েছিল ১ কোটি ৪ লাখ ৮ হাজার ৯১৮টি পশু। এর মধ্যে ছিল ৪৭ লাখ ৬৬ হাজার ৮৫৯টি গরু, ১ লাখ ১২ হাজার ৯১৮টি মহিষ, ৫০ লাখ ৫৬ হাজার ৭১৯টি ছাগল, ৪ লাখ ৭১ হাজার ১৪৯ ভেড়া এবং ১ হাজার ২৭৩টি অন্যান্য পশু (উট, হরিণ ইত্যাদি)। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে কোরবানিকৃত পশুর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৬৭ হাজার ১০৬টি বা ৩.৬৬ শতাংশ বেশি। এ বছর কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে প্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৭টি পশু। এর মধ্যে রয়েছে ৫৬ লাখ ২ হাজার ৯০৫টি গরু-মহিষ, ৬৮ লাখ ৩৮ হাজার ৯২০টি ছাগল-ভেড়া, ৫ হাজার ৫১২টি অন্য প্রজাতির পশু। এ বছর ৫ শতাংশ হারে চাহিদা বৃদ্ধির সম্ভাবনা ধরে নিয়ে পশুর চাহিদা হতে পারে ১ কোটি ৯ লাখ ২৯ হাজার ৩৬৪টি পশু। তাতে উদ্বৃত্ত থাকবে প্রায় ১৫ লাখ ১৭ হাজার ৯৭৩টি পশু। করোনা মহামারি ও আর্থিক স্থবিরতার কারণে গত ৪ বছর কোরবানির পশুর চাহিদা ছিল কম। ফলে অবিক্রীত থেকে গেছে অনেক পশু। এবার কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে চাহিদা। তবে সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতি ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে পশুর মূল্য বেশি হতে পারে। সে কারণে পশু বিক্রি কম হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন খামারিরা। এমন পরিস্থিতিতে ঈদের আগে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক পশু আমদানি পুরোপুরি বন্ধ রাখা উচিত।
২০২৪ সালে কোরবানির জন্য প্রস্তুত ছিল ১ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি পশু। এবারের জোগান তার চেয়ে ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৩০টি কম। এর প্রধান কারণ বন্যা। গত বছর দেশের ১৬টি জেলায় মারাত্মক বন্যা হয়েছে। তাতে গরু-ছাগলের উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক পশু পানিতে ভেসে গেছে। রোগে মরে গেছে অনেক পশু। তার আগে প্রচন্ড খরার কারণেও বাধাগ্রস্ত হয়েছে পশুর উৎপাদন। তারপরও এবার পশুর মোট জোগান থাকবে চাহিদার তুলনায় বেশি। এক হিসাব থেকে দেখা যায়, ২০১৬ সালে কোরবানির বাজারে ৯৮ লাখ ১৩ হাজার পশু বিক্রি হয়েছিল। এর ৮ বছর পর ২০২৪ সালে চাহিদা বেড়েছে ৫ লাখ ৯৫ হাজার ৯১৮টি পশুর। ৮ বছরে মোট প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ শতাংশ। প্রতিবছর গড়ে কোরবানির পশুর চাহিদা বেড়েছে ১ শতাংশের কম। করোনা মহামারির কারণে ২০২১ সালে মোট পশুর চাহিদা ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টিতে নেমে যায়। ২০১৯ সালে যা ছিল সর্বোচ্চ ১ কোটি ৬ লাখ ১৪ হাজার পশু। গত ২ বছর কোরবানির পশুর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু তা কখনো ২০১৯ সালের মাইলফলক স্পর্শ করতে পারেনি। অর্থাৎ পশুর উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও কার্যকর চাহিদা তেমনভাবে বাড়েনি।
বাংলাদেশে মাংসের দাম দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৫ সালে গরুর মাংসের দাম ছিল প্রতি কেজি ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা। এখন তা বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৫০ থেকে ৮৫০ টাকায়। সেই সঙ্গে ভেড়া ও খাসির মাংসের দামও বেড়েছে হাজার টাকা থেকে বারো শ’ টাকায়। ভারত থেকে গরু রপ্তানিতে বাধা দিয়েছিল সনাতন হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী একশ্রেণির লোক। ২০১৫ সাল থেকে তা আমলে নেয় বিজেপি সরকার। তাতে বাংলাদেশে ভারতীয় গরুর আমদানি ও চোরাচালান হ্রাস পায়। ফলে দেশে বেড়ে যায় মাংসের দাম। এ সুযোগে দেশে উৎপাদিত গরু মোটাতাজাকরণে কৃষকগণ উদ্বুদ্ধ হয়। দ্রুত গড়ে ওঠে খামার। এখন মাংসের উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ম্ভর। কিন্তু দাম বেশ চড়া। তাতে খামারীরা লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু নিরুৎসাহিত হচ্ছেন নিম্ন আয়ের অসংখ্য ভোক্তা। এমতাবস্থায় পশুপ্রতি মাংসের উৎপাদন বাড়িয়ে প্রতি ইউনিট খরচ হ্রাস করা জরুরি। সাধারণত সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে পণ্যের দাম হ্রাস পায়। কিন্তু আমাদের দেশে পশুসম্পদ খাতে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এখানে একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। তারা মাংসের দাম কমতে দিচ্ছে না। এমতাবস্থায় পশু খামার উন্নয়নে সহযোগিতা প্রদানের পাশাপাশি গ্রামীণ চিরায়ত কৃষকদের গবাদিপশু পালনে উৎসাহিত করা উচিত।
বাংলাদেশে বর্তমানে গবাদিপশুর সংখ্যা ৫ কোটি ৭৫ লাখ ৬০ হাজার। এর মধ্যে গরু ২ কোটি ৫০ লাখ ১০ হাজার, মহিষ ১৫ লাখ ২০ হাজার, ছাগল ২ কোটি ৭১ লাখ ২০ হাজার এবং ভেড়া ৩৯ লাখ ৫ হাজার। মোট মাংসের উৎপাদন ৯২ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন। এর প্রায় ৬০ শতাংশ জোগান আসে গবাদিপশু থেকে। ৪০ ভাগ আসে হাঁস-মুরগি থেকে। মোট মাংস সরবরাহে গরুর অংশীদারিত্বই বেশি। কিন্তু এর বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার কম। ছাগল-ভেড়ার প্রবৃদ্ধির হার বেশি। কোরবানিতে গরুই মানুষের বেশি পছন্দ। ৭ নামে ভাগ করা যায়। আবার একাও একটি গরু কোরবানি করা যায়। এবার মূল্যস্ফীতি ও আর্থিক সংকটের কারণে শরিকে কোরবানির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। যিনি ১টি গরু কোরবানির কথা ভাবছিলেন তিনি হয়ত শরিকে, যিনি একাধিক শরিকে কোরবানির কথা ভাবছিলেন তিনি ১ শরিকে কোরবানি দেবেন এবং যিনি ১ শরিকের কথা ভাবছিলেন তিনি হয়ত কোরবানি দেওয়া থেকে সরে দাঁড়াবেন। ছাগল ও ভেড়া কোরবানি বৃদ্ধি পেতে পারে। কারণ একজন এক নামে কোরবানি করেন একটি ছোট পশু। এর দাম কম। ২০১৫ সালে মোট ছাগল-ভেড়া বা ছোট পশু কোরবানি হয়েছিল ২৩ লাখ ৪৮০ হাজার। ২০২৪ সালে তা ৫৫ লাখ ২৭ হাজার ৮৬৮তে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে কোরবানিকৃত পশুর ৪৬ শতাংশ গরু, ১ শতাংশ মহিষ, ৪৮.৫ শতাংশ ছাগল, ০.৪ শতাংশ ভেড়া এবং ০.১ শতাংশ অন্যান্য পশু।
আগে প্রতিটি কৃষক পরিবারে গরু পালন করা হতো। তখন চাষাবাদ হতো লাঙ্গল দিয়ে। এখন এসেছে কলের লাঙ্গল। গরু দিয়ে হালচাষ ও শস্য মাড়াই প্রায় উঠেই গেছে বলা চলে। আগে যেখানে শতকরা ৯০ ভাগ হালচাষ করা হতো লাঙ্গল দিয়ে, এখন সে পরিমাণের বেশি হয় ট্রাক্টর ও টিলার দিয়ে। বাকি অল্প চাষাবাদ হয় পশু ও মানবশক্তির মাধ্যমে। হালচাষে ও শস্য মাড়াই কাজে গরুর ব্যবহার হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে গ্রামের কৃষকদের অনেকেই চিরায়ত পদ্ধতিতে গরু পালন প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। যারা এখনো গরু পালেন তারা তা করেন মূলত দুধ অথবা মাংসের জন্য। দুগ্ধ খামার গড়ার জন্য বর্তমানে পশু ক্রয়ে স্বল্প সুদে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ দেওয়া হচ্ছে। স্বল্প সুদে ঋণ পাচ্ছেন দুগ্ধ খামারের মালিকরা। ফলে দুগ্ধ খামার গড়ার জন্য এগিয়ে এসেছেন অনেক শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তা। তাতে বেড়েছে দুধের উৎপাদন। বকনা তৈরি হচ্ছে মাংস উৎপাদন ও কোরবানির জন্য।
মাংসের জন্য যারা গরু পালেন তাদের বড় সুযোগ কোরবানির ঈদ। গবাদিপশু হৃষ্টপুষ্টকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা পশু খামার গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন এলাকায়। একজন খামারি গড়ে ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা খরচ করে উন্নত জাতের একটি বাছুর ক্রয় করে। তারপর প্রায় ১ বছর পর্যন্ত ওই গরুটির পেছনে প্রতিমাসে প্রায় ৯ হাজার টাকা খরচ করেন। এটি মোটাতাজাকরণের পর বিক্রি হয় ১.৫ লাখ থেকে ৩ লাখ টাকায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি অনুষদে পরিচালিত একজন ছাত্রের পিএইচডি থিসিসের বর্ণনায় দেখা যায়, মোটাতাজার জন্য বাছাইকৃত গরুর অধিকাংশের বয়স ২ থেকে ৪ বছর। এগুলো উন্নত জাতের ষাঁড়। এগুলো প্রতিপালন করা হয় নিবিড় পরিচর্যায়। প্রথমে এগুলোকে কৃমিমুক্ত করা হয়। এরপর নিয়মিত খাওয়ানো হয় ইউরিয়া-চিটাগুড় সংমিশ্রণে খড়, কিছু দানাদার মিশ্রণ ও কাঁচা ঘাস। এভাবে গরুগুলোকে পরিচর্যা করা হয় ২ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে গরু হৃষ্টপুষ্টকরণের যে প্যাকেজ প্রযুক্তি কৃষকদের জন্য উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে, তা ৩ থেকে ৪ মাসের। মাঠপর্যায়ের সমীক্ষা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মোটাতাজাকরণের মাধ্যমে প্রতিদিন একটি উন্নত জাতের গরুর ওজন ৭০০ থেকে ১০০০ গ্রাম পর্যন্ত এবং দেশী গরুর ওজন ১০০ থেকে ৪৫০ গ্রাম পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। গরু মোটাতাজাকরণের প্রধান খরচ হলো খাদ্যমূল্য, ওষুধের দাম ও শ্রমিকের মজুরি। এসব খরচ বাদ দিয়ে একজন কৃষক প্রতিটি গরুতে গড়ে নিট লাভ করেন ১৩ হাজার ৩৫০ টাকা। অনেক সময় কৃষক বেশি লাভের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন কোরবানির হাটে। তাতে তাদের অনেক গরু অবিক্রীত থাকে। তাই খামারীদের উচিত হবে অল্প লাভে দ্রুত গরু বিক্রি করে দেওয়া। তাতে মোট বিক্রি বৃদ্ধি পাবে। ভোক্তারা খুশি থাকবেন। ব্যবসাও চাঙ্গা হবে।
অনেকের ধারণা, মোটাতাজাকরণে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর স্টেরয়েড, এন্টিবায়োটিক ও রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। কয়েক বছর আগে হয়ত তা দেখা যেত কোনো কোনো ক্ষেত্রে। সম্প্রতি তা আর চোখে পড়ে না। গো-খাদ্যে এসব ক্ষতিকর উপকরণ মেশানো প্রতিরোধে এখন ভেটেরিনারি মেডিক্যাল টিম পরিবীক্ষণ করছে। এসব নিষিদ্ধ উপকরণ গো-খাদ্যে মেশানোর প্রমাণ পেলে আইন ও বিধি অনুযায়ী মামলা করা যায়। এক্ষেত্রেও জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। ফলে গরু মোটাতাজাকরণে ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার এখন আর তেমন দৃষ্টিগোচর হয় না। এবার কোরবানির পশুর হাটে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ভেটেরিনারি মেডিক্যাল টিম ও বিশেষজ্ঞ মেডিক্যাল টিম নিয়োজিত থাকবে। তারা আক্রান্ত পশুর চিকিৎসা দেবে এবং ক্রেতা ও বিক্রেতাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবে।
কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করা এবং তার উপযুক্ত দাম পাওয়া একটি বড় সমস্যা। গত কয়েক বছর ধরে প্রান্তিক পর্যায়ে চামড়ার মূল্য বড় ধরনের ধস আমরা লক্ষ্য করছি। এরও প্রতিকার দরকার। আন্তর্জাতিক দামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের অভ্যন্তরে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা এবং তা বাস্তবায়ন করা উচিত। নির্ধারিত মূল্যে যাতে কৃষকদের কাছ থেকে চামড়া ক্রয় করা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। কোরবানির চামড়ার বিক্রয়লব্ধ অর্থের মালিক দরিদ্রজন, এতিম ও মিসকিন। ফলে চামড়া ভালোভাবে সংরক্ষণ ও এর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সবারই দায়িত্ব। গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন মহল চামড়া ক্রয়ে তৎপর। তারা কারসাজি করে অতি অল্প দামে মাঠপর্যায় থেকে চামড়া কিনে অনৈতিক মুনাফা লুটছে। এতে টেনারির মালিকদেরও যোগসাজশ থাকতে পারে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত।
কোরবানির সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে মহাসড়ক ও চৌরাস্তার মোড়ে ফাঁকা জায়গা পেলেই পশুর হাট বসিয়ে দেওয়া হয়। তাতে বড় ধরনের যানজট সৃষ্টি হয়। মানুষের চলাচলে অসুবিধা হয়। তাছাড়া পশুবাহী গাড়িতে চাঁদাবাজি হয়। তাতে পশুর দাম বেড়ে যায়। সম্প্রতি সীমান্তের নজরদারি এড়িয়ে অবৈধ পথে গরু আমদানি করা হচ্ছে বলে খবর আসছে। এটি দেশের উদ্যোক্তাদের জন্য ক্ষতিকর। এ সকল বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ, সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ
প্যানেল