ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৬ মে ২০২৫, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

‎বিষে ভরা বুড়িগঙ্গা - এই দায় কার?

আব্দুল্লাহ্ খান, কনট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ২১:০৩, ২৫ মে ২০২৫

‎বিষে ভরা বুড়িগঙ্গা - এই দায় কার?

ছবিঃ সংগৃহীত

একসময় ঢাকার বুকে জীবনদায়ী এক নীল শিরা ছিল বুড়িগঙ্গা। হাজার বছরের রাজধানী এই নদীর বুকেই গড়ে উঠেছিল ব্যবসা-বাণিজ্য, যাতায়াত, সংস্কৃতি ও সভ্যতা। সাহিত্যে, লোককথায়, এমনকি গানে পর্যন্ত যার প্রশংসা হয়েছে বারবার। কিন্তু আজ?

‎বুড়িগঙ্গা এখন ঢাকার এক বিষাক্ত, মৃতপ্রায় নদী যেখানে নেই প্রাণ, নেই প্রবাহ, নেই প্রাণের কোনো চিহ্ন। ‎সদরঘাটের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালেই বোঝা যায়, এই নদী বয়ে চলার চেয়ে ধুঁকে ধুঁকে বাঁচছে। গাঢ় কালো পানি, অসহ্য দুর্গন্ধ, পানিতে ভাসছে মৃত মাছ, পচা আবর্জনা আর মানুষের বর্জ্য।

‎ঢাকার হৃদয়ে বয়ে চলা এই নদী একসময় ছিলো নগরীর জীবনের উৎস, মানুষের আশার স্রোত। ছোটবেলা থেকে অনেকেরই মনে থাকবে নদীর পাড়ে হাঁটা, নৌকায় চড়ে ঝরঝরে জলের ছোঁয়া অনুভব করার মধুর স্মৃতি। বুড়িগঙ্গা ছিলো শুধুই জলপথ নয়, সংস্কৃতি, জীবিকা আর ইতিহাসের স্বরূপ। তবে আজ এই নদী সেই রূপে নেই। এখন সে এক বিষাক্ত তরঙ্গমালা, বিষাক্ত ক্যানভাসে আঁকা এক ভয়াবহ ছবি, যেখানে প্রকৃতির পরিবর্তে বিষ আর বর্জ্য রাজত্ব করছে।

‎দেখতে দেখতে বুড়িগঙ্গা হয়ে উঠেছে এক মৃত নদী। গত কয়েক দশকে অবাধ শিল্পায়ন ও নগরায়নের নামে হাজার হাজার কারখানা, ট্যানারি, ডাইং ও বস্ত্র কল তাদের বিষাক্ত বর্জ্য ঢুকিয়েছে নদীর বুকের মাঝখানে। সেখানে আরও যুক্ত হয়েছে হাজার হাজার বাড়ির পয়ঃনিষ্কাশন। নদী আজ আবর্জনার কনটেইনার।যেখানে শুধু পলিথিন, প্লাস্টিক, মৃত মাছ, চামড়ার অবশিষ্টাংশ আর কলকারখানার রাসায়নিক ভেসে বেড়ায়।

‎নদীর পানি আগের মতো স্বচ্ছ আর শীতল নেই। বরং তা গন্ধযুক্ত, কালো, জ্বলন্ত, প্রাণহীন। যে পানিতে মানুষ আগে গোসল করতো, মাছ শিকার করতো, জীবন নির্বাহ করতো। আজ সেই পানিতে বিষক্রিয়া চলছে শরীর আর মনের।

বুড়িগঙ্গার মাঝি মোস্তফা, যিনি ছোটবেলা থেকে এই নদীর সঙ্গে কাটিয়েছেন জীবন। তিনি বলেন, “আগে এই নদীটা ছিল আমার বইনের মতো। মাছ ছিল, জাহাজ চলত। এখন দেহেন, নদীতে কেমন মরা মাছ ভাসে, পচা গন্ধ, প্লাস্টিকের পাহাড়। আমরা আর মাছ ধরবের পারি না, নৌকা চালাতে ভয় লাগে। নদী মাইরা গেছে। আমরা তার জন্য কিছু করতে পারি নাই।”
‎মাঝির কথায় নদীর বিষন্নতা স্পষ্ট। মানুষের জীবনের সঙ্গে নদীর সম্পর্ক আজ একেবারে ছিন্ন। তারা শুধু দুঃখের শিকার।

কারখানার অবাধ বর্জ্য ফেলা,নদীর মৃত্যু:

‎ঢাকার বুকে অবস্থিত হাজার হাজার কারখানা—বিশেষ করে ট্যানারি-নদীর সবচেয়ে বড় শত্রু। বৈধ কিংবা অবৈধ, সকলেই প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার বিষাক্ত বর্জ্য ছাড়ে নদীতে। রং, রাসায়নিক, বিষাক্ত পদার্থ নদীর জলকে ধীরে ধীরে বিষাক্ত করছে।
‎সরকারি গবেষণায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার পানিতে আয়রন, সিসা, পলিউট্যান্ট, সোডিয়াম ও অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থ বিপজ্জনক মাত্রায় রয়েছে। এইসব পদার্থ শুধু মাছের প্রাণ নষ্ট করে না, মানবস্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক হুমকি।

‎অবহেলা ও অবজ্ঞা: নদীর প্রতি রাষ্ট্রের ভূমিকা
‎বুড়িগঙ্গার এই বিপর্যয় দেখা সত্ত্বেও, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে খুব একটা কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা অন্যান্য সরকারি সংস্থাগুলো নানা ধরনের নিয়ম ও আইন করলেও, বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। নদী রক্ষায় সরকারী উদ্যোগ অনেক সময় হয় কাগজেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। শিল্প মালিকদের ক্ষমতা ও দুর্নীতি অনেক সময় আইন প্রয়োগকে নস্যাৎ করে দেয়।

স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তাদের অমনোযোগিতা ও ঘুষ-খাওয়ার সংস্কৃতিও এই দূরাবস্থার অন্যতম কারণ। ফলে বুড়িগঙ্গা প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে, অথচ কেউ সে দিকে নজর দিচ্ছে না।

‎নদী না থাকলে ঢাকা শহরের জলবায়ু, পরিবেশ ও জীবনধারা মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়বে। বিশেষ করে বুড়িগঙ্গার পানি অনেক এলাকায় ভূগর্ভস্থ জলের সাথে মিশে থাকে। নদী দূষিত হওয়ায় ভূগর্ভস্থ জল ও মাটিও বিষাক্ত হচ্ছে। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে।

বুড়িগঙ্গার পরিবেশ সংকট ঢাকার নাগরিকদের শ্বাস-প্রশ্বাস ও দৈনন্দিন জীবনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের রোগ, ত্বকের সমস্যা এমনকি ক্যান্সারসহ নানা রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

‎নদী রক্ষার জন্য শুধু সরকার নয়, প্রয়োজন জনসচেতনতার। মানুষকে জানতে হবে নদী কেন বাঁচাতে হবে, তার গুরুত্ব কী। আজকাল অনেক এনজিও, সেচ্ছাসেবী সংস্থা বুড়িগঙ্গার জন্য সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করছে। তারা নদী পরিষ্কার অভিযান, সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালাচ্ছে।

‎আবারো শ্বাস নেবে বুড়িগঙ্গা -তার প্রশ্বাসে প্রাণ পাবে ঢাকা। একটা নদীর জলে যদি ফেরে জীবন, তবে ফিরে আসতে পারে শহরেরও হৃদস্পন্দন।

আলীম

×