ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৬ মে ২০২৫, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

রাজশাহীর বড়কুঠি: ইতিহাস, ঐতিহ্য ও নির্যাতনের কালের সাক্ষী

তানভীরুল আলম তোহা, কনট্রিবিউটিং রিপোর্টার, রাজশাহী

প্রকাশিত: ০০:২১, ২৬ মে ২০২৫

রাজশাহীর বড়কুঠি: ইতিহাস, ঐতিহ্য ও নির্যাতনের কালের সাক্ষী

পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে রাজশাহীর খ্যাতি দেশজুড়ে। তবে এই পরিচ্ছন্নতার আড়ালে লুকিয়ে আছে শত শত বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং নীরব কিছু নির্যাতনের গল্প। ঠিক পদ্মা নদীর তীরে, রাজশাহী কলেজের দক্ষিণে ও সাহেব বাজারের কাছাকাছি অবস্থিত এমনই এক ঐতিহাসিক স্থাপনা বড়কুঠি।

বড়কুঠি শুধু একটি পুরনো ভবন নয় এটি একেকটি ইট, একেকটি দেয়াল যেন বাংলার কৃষকদের কান্না, বেদনা আর প্রতিবাদের নীরব দলিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ওলন্দাজ রেশম ব্যবসায়ীরা এই ভবনটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে ১৮১৪ সালে ডাচরা তাদের বাণিজ্য গুটিয়ে নিলে এটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে যায়।

১৮৩৩ সাল পর্যন্ত ডাচরা এটি বাণিজ্যিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করলেও, ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রশাসনিক ভবন।

ইট নির্মিত দুইতলা এই ভবনের বাইরের দৈর্ঘ্য ২৪ মিটার এবং প্রস্থ ১৭.৩৭ মিটার। ভবনজুড়ে রয়েছে ১২টি কক্ষ, যার মধ্যে উপরের তলায় রয়েছে ৬টি ঘর এবং একটি সভাকক্ষ। রয়েছে পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণে খোলা বারান্দা, যা ভবনটিকে একটি দুর্গের রূপ দিয়েছে।

বিশেষ প্রয়োজন হলে এই বড়কুঠি ছিল ওলন্দাজদের দুর্গ। ছাদ ও নিচতলায় প্রস্তুত থাকত কামান, যা দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করা হতো। যদিও পরবর্তীতে ইংরেজদের দখলে যাওয়ার পর ১৮৩৩ সালে এসব কামান সরিয়ে নেওয়া হয়। বর্তমানে এর তিনটি কামান রাজশাহী পুলিশ লাইনে সংরক্ষিত আছে।

তবে এই বড়কুঠিকে ঘিরে সবচেয়ে আলোচিত অংশ হচ্ছে *মাটির নিচের রহস্যময় সুরঙ্গপথ। ভবনের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে রয়েছে সরু পাকানো সিঁড়ি, যা নেমে গেছে ভূগর্ভে। নিচে রয়েছে একটি বিশাল কক্ষ, যার ভেতর দিয়েই পদ্মা নদীর তলদেশে নির্মিত ছিল সেই রহস্যময় সুড়ঙ্গ। কথিত আছে, সেই সুরঙ্গ দিয়ে একসাথে দশটি ঘোড়া দৌড়াতে পারত! এই পথটি গিয়ে মিশত বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার রাজবাড়ি পর্যন্ত।

বর্তমানে এই সিঁড়ির নিচের অংশ প্রাচীর দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তবে সেই রহস্য আজও মানুষকে টানে।

তবে বড়কুঠির ইতিহাস শুধু বাণিজ্য কিংবা স্থাপত্যে সীমাবদ্ধ নয় এই ভবনটি একসময় নীলচাষের নামে কৃষকদের উপর চালানো ভয়াবহ নির্যাতনের কেন্দ্র ছিল। এখানেই বাংলা কৃষকদের ওপর চলত নিপীড়ন, যা ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হয়ে রয়েছে।

রাজশাহীর এই বড়কুঠি কেবল একখণ্ড পুরনো ইট-পাথরের ভবন নয় এটি আমাদের অতীত, আমাদের সংগ্রাম, আর বহু নির্যাতনের এক নীরব স্বাক্ষর।

মিমিয়া

×