
ছবিঃ সংগৃহীত
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নাম অনুযায়ী এটি মোঘল আমলের মিরকাদিম সেতু। লোকমুখে আছে একরাতে জ্বীন-পরী তৈরি করেছে এ সেতু। তাই অনেকে বলেন গায়েবী ব্রীজ। ভিন্ন নাম আর নানা গল্পকথা থাকলেও স্থাপনাটি ঠিক কবে নাগাদ তৈরি করা হয়েছে তা জানে না কেউ।
বলছি মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিম-টঙ্গীবাড়ি সংযোগ খালের উপর কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন "পুলঘাটার ইটের পুলের" কথা। যাকে ঘিরে স্থানীয়দের মাঝে রয়েছে নানা কল্পনার আর ইতিহাসের সংমিশ্রনের বিভিন্ন লোককথা বা কিংবদন্তি। ঐতিহাসিকদের মতে সেতুটি বিলুপ্ত প্রাচীন বিক্রমপুর মহানগরের সীমানা পরিখা খালের ওপর মোগল আমলে তৈরি করেছে।
বর্তমানে যার পূর্ব পাশে সদর উপজেরার পানাম পুলঘাটা ও পশ্চিম পাশে টঙ্গীবাড়ী উপজেলার আব্দুল্লাপুরকে সংযুক্ত করেছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০০৬ সালে মিরকাদিম খালের ওপর পানাম-পুলঘাট সেতুটি সংরক্ষণের আওতায় বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। তিন খিলান বিশিষ্ট সেতুটি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়নি কোন লোহার কাঠামো। শুধু মাত্র চুন-সুড়কি ব্যবহারে নির্মিত ধনুকাকৃতির ইটের সেতুটির দৈঘ্য ৫২ দশমিক ৪২ মিটার। সেতুটিতে তিনটি খিলানের মধ্যে কেন্দ্রীয় খিলানটি ৪.২৫ মিটার প্রশস্ত এবং পাশের দুটি খিলান ২.১৭ মিটার করে প্রশস্ত। সঠিক নির্মাণকাল ও নির্মাতা সম্পর্কে জানা না গেলেও ধারণা করা হয় এটি নির্মিত হয়েছিল মোগল আমলে ১ হাজার ৭০০ শতকে রাজা বল্লাল সেনের সময়। বিভিন্ন সময় সেতুটি সংস্কারের ফলে এর আদিরূপ অনেকটাই বিলীন হয়ে গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সেতুলির সংস্কার করে এর দুই পাশে দু'টি সতর্কীকরণ নোটিশ পুঁতে দেয়। ওই নোটিশে সেতুর দেওয়ালে কোনো কিছু লেখাসহ অবকাঠামোর ক্ষতিসাধন করলে দণ্ডনীয় অপরাধের সতর্কবার্তা ছিল। তবে মূল সাইনবোর্ডটি ছেড়া। তার উপর লেখা মিরকাদিম সেতু। তিন খিলানে মধ্যে মাঝেরটি দিয়ে ছোটি মাঝারি নৌযান চলাচল করে। আর সেতুটি ব্যবহার করে শতশত বছর ধরে মানুষের পারাপার এখনো রয়েছে। বর্তমানে মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, সিএনজি, পিকআপ সহ বিভিন্ন ছোটবড় যানবাহনও চলাচল করে সেতুটি দিয়ে।
তবে সেতুটি ঘুরে দেখা যায়, সেতুর নিচ দিয়ে ট্রলারসহ নৌযান যাওয়ার সময় সেতুতে আঘাত লাগায় দুই পাশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন অংশের চুন ও সুরকির আস্তর উঠে গেছে। সেতুর পাশেই দেওয়াল ঘেঁষে ইট-বালুর ব্যবসা চলছে। সেতুর পূর্ব পাশের দক্ষিণ দিকে ১০ গজের মধ্যেই স্থানীয় কয়েকটি নির্মাণাধীন দোকানঘর।
স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিন বিকালেই দুরদুরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন ঐতিহাসিক নির্দশনটি দেখার জন্য। ছুটির দিন ও বিভিন্ন উৎসবে গ্রচুর সংখ্যাক মানুষের উপস্থিতি হয়। কেউ আসেন বন্ধুর দলে কেউ আসেন সপরিবারে। প্রায় বিদেশি দর্শনার্থী ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের আগমনও ঘটে।
স্থানীয় বাসিন্দা রাজু সরকার জানান, জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই সেতুটি এখানে দেখতে পাচ্ছি। বাপ দাদার মুখেও গুনেছি তারাও ছোট থেকে সেতুটিকে এভাবেই দেখছে। তবে ঠিক কে করেছে তা জানিনা। সেতুটিকে নিয়ে নানা মানুষ নানা কথা বলেন। আমার ছোটবেলায় শুনতান জীন-পরী একরাতে এই সেতু করেছে। আবার মাটির নিচ থেকে উঠেছে বলেও প্রচলিত আছে। তবে এটি মানব তৈরি সেতু।
আরেক বাসিন্দা মোঃ আলিফ বলেন, বহু মানুষের আগম ঘটে এই সেতুতে। অনেকে এসে ছবি তুলেন। তবে সেতু এলাকায় পর্যটকের জন্য বিশেষ কোন সুবিধা না থাকায় অনেকে নিরাশ হয়। আর সেতুটির বিভিন্ন অংশও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এগুলো ঠিক করা প্রয়োজন।
আব্দুল্লাপুর এলাকার বাসিন্দা মো. সুজন বলেন, নিয়মিত সেতুটি দিয়ে যাতায়াত করি। এটি একটি নান্দনিক স্থাপনা। তবে বান্ধহেড সহ বিভিন্ন নৌযান চলাচলে নিচে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আর উপরে উপরের রেলিংয়ে বড় একটি বড় অংশ ভাঙা অবস্থায় রয়েছে। পর্যটনবান্ধব করতে এগুলো সংস্কার করা প্রয়োজন।
এবিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক হালিমা আফরোজ মুন্সীগঞ্জের সময়কে বলেন, পুলঘাটা সেতুটি সংস্কারে আমাদের অগ্রধিকার পরিকল্পনা রয়েছে। এরমধ্যে গত শুক্রবার (২৩ মে) প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক সেতু এলাকা পরিদর্শন করেছে। সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকতারা ও প্রকৌশলীরাও ছিলোন। এ অর্থবছর শেষ প্রায়, জুন-জুলাইয়ে নতুন অর্থ বছরে সেতুটি সংস্কারের পরিকল্পনা রয়েছে। সেতুটি সংস্কারে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হবে।
যেভাবে পৌছাবেন- রাজধানী ঢাকা থেকে দুইভাবে পুলঘাটা ইটের পুল বা পানাম সেতুতে পৌঁছানো যায়। গুলিস্তান থেকে নারায়নগঞ্জ থেকে মুন্সীগঞ্জে যাওয়া আসার বিআরটিসি অথবা বেসরকারি বাস রয়েছে। যা মুন্সীগঞ্জ সদরের মুক্তারপুর এলাকায় পৌছায়। বিআরটিসি বাসের ভাড়া ১২০টাকা, অন্যদিকে লোকাল বাসে ভাড়া ৮০ টাকা। মুক্তারপুর পৌঁছে অটোরিকশা যোগে সিপাহীপাড়া- হাতিমারা হয়ে ৬০-৭০টাকা ভাড়ায় পৌছানো যায় পুলঘাটা এলাকায়।
এদিকে গুলিস্তান থেকে বিকল্প ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেস হয়েছে মুন্সীগঞ্জের টংগিবাড়ী উপত্তেরার বেতকা পৌছানোর দীঘিরপাড় ট্রান্সপোর্ট সহ বিভিন্ন বাস পাওয়া যায়। বাস যোগে বেতকা চৌরাস্তা পৌছে অটোরিকশা যোগে আব্দুল্লাপুর হয়ে পৌঁছানো যায় পুলঘাটা এলাকায় ভাড়া ৪০-৫০ টাকা।
আলীম