ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৬ মে ২০২৫, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

তানজিদ-তাছিন দুই শিশু সন্তানের জন্য বিরামহীন সংগ্রাম এক মায়ের!

শেখ ফয়সাল আহমেদ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, মিরপুর, ঢাকা

প্রকাশিত: ০১:২৮, ২৬ মে ২০২৫

তানজিদ-তাছিন দুই শিশু সন্তানের জন্য বিরামহীন সংগ্রাম এক মায়ের!

ছবি: সংগৃহীত

সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যুগেযুগে স্মরণীয় হয়ে আছে অনেক গর্ভধারিনী মায়ের লড়াই সংগ্রামের গল্প সন্তানের জন্য,হোক সে বালিকা আর নাবালিকা একজন নারী যখন মাতৃত্বের স্বাদ পায় তখন সমগ্র পৃথিবীর সাথে সে যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে তার সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, নিজের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়ে সংগ্রাম করে মায়েরা হৃদয়ের গহীনে সুপ্ত বাসনা নিয়ে লড়াই করে সন্তানের জন্য বেঁচে থাকুক সন্তান এরাই জীবনের অবলম্বন বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা তেমনই একজন মা ১৯ বছরের কিশোরী তানজিলা আক্তার।

মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ২ ও ৩ নাম্বার গেটের মাঝখানে প্রতিদিন বিকেল থেকে সাহায্যের জন্য বসে থাকে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে ১৯ বছর বয়সী তানজিলা আক্তার।

কথা হয় তানজিলা আক্তারের জন্ম একটি দরিদ্র পরিবারে টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ী উপজেলায় বকুলতলা গ্রামে, তানজিলা আক্তার যখন পৃথিবীর আলো দেখে তখন নিভে যায় তার মায়ের জীবন প্রদীপ, বাবা আনোয়ার রাজমিস্ত্রির কাজ করেন তানজিলা জন্মের সময় তার মা মারা যায় তানজিলার বড় ভাই সোহেল ও বড় বোন লতাকে নিয়ে বাবা হয়ে যেন অসহায় সন্তানদের জন্য দ্বিতীয় বিবাহ করেন ঘরে আসে সৎ মা।

তবে সৎ মায়ের গল্পটা ভিন্ন নিজের গর্ভের সন্তান না হলেও তিনজনকে আপন সন্তানের মতোই লালন পালন করে কিন্তু রাজমিস্ত্রি আনোয়ারের দারিদ্রতা কোনভাবেই পিছু ছাড়ে না, অবশেষে তানজিলা মাত্র ১৪ বছর বয়সে বড় বোনের সঙ্গে চলে আসেন ঢাকায় গাজীপুরে কাজের উদ্দেশ্যে। একটি গার্মেন্টসে দুই বোন একত্রে চাকরিতে ঢোকেন। চাকরি করা অবস্থায় তানজিলা ময়মনসিংহের আবু সাঈদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন পরিবারের অমতে বিয়ে করে ফেলেন কিশোরী বয়সেই, পরিবার থেকে হয়ে যান বিচ্ছিন্ন, দুটি সন্তান জন্ম দান করেন বড় ছেলের নাম তানজিদ বয়স তিন বছর আর ছোট ছেলের নাম তাছিন এক বছর চার মাস, থাকার কথা ছিল সংসারে সুখ কিন্তু দ্বিতীয় সন্তান আসার পরেই স্বামী আবু সাঈদের চরিত্রের আমুল পরিবর্তন হতে শুরু করে একাধিক নারীদের সাথে অবৈধ সম্পর্কের লিপ্ত হন মাদকাসক্ত হয়ে যান এবং স্ত্রীকে প্রতিদিন করতেন অমানুষিক নির্যাতন, মুখ বুঝে নির্যাতন সহ্য করতেন তানজিলা কারণ তার ফিরে যাওয়ার কোন জায়গা নেই।

কিন্তু পাঁচ মাস আগে দুই শিশু সন্তানকে ফেলে স্বামী আবু সাঈদ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।

স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়াতে তানজিলার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল থাকেন মিরপুর ১৪ নাম্বার টেকেরপার বস্তিতে, কিভাবে দুই সন্তানের মুখে খাবার ও দুধ কিনে দিবেন, আর সন্তানদেরকে রেখে কোথাও কোন কাজে যাওয়ার সুযোগ নেই অবশেষে নিরুপায় হয়ে মিরপুর ২ নাম্বার স্টেডিয়ামের দুই ও তিন নম্বর গেটের মাঝখানে বসে পড়েন সাহায্যের হাত পেতে, কত টাকা ইনকাম হয় জানতে চাওয়া হলে তানজিলা বলেন কোনদিন ২০০ ৩০০ ৪০০ এরকম হয়, একবেলা খান মিরপুর ১ নম্বরে ভালো কাজের হোটেলে, কিন্তু সেখানে অনেকে তার ভিডিও করতে চায় ছবি তুলতে চায় কাউকে সে অনুমতি দেন না, যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে কোনরকম সন্তানদের নিয়ে বেঁচে আছেন।

পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন কিনা বা নিজের অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে বলেন মা বাবা বলেছে সন্তানকে ফেলে দিয়ে গ্রামে ফিরে আসতে তাকে খাওয়াবে, বড় বোন দুলাভাই ও বড় ভাই একই কথা বলেছে সন্তানকে ফেলে দিয়ে চলে আয় তোর ভরণপোষণ আমরা দিব। কিন্তু অনড় তানজিলা নিজের নারী ছেড়া ধনকে কখনোই ছাড়বেন না আর এই দুই সন্তানের জন্য প্রতিদিন করছেন সংগ্রাম।

স্বামী চলে যাওয়াতে প্রতিনিয়ত আসছে কু প্রস্তাব কিন্তু নিজের সতীত্বকে বিসর্জন দিতে চান না, রাস্তায় বসে থাকা অবস্থায়ও অনেকেই তাকে বিভিন্ন অফার দেন কখনো প্রতিবাদ করেন আবার কখনো নীরবে মুখ বুজে সহ্য করেন বলতে বলতে অঝোর ধারায় কেঁদে ফেলেন বলেন মানুষ এত খারাপ কেন, দুই তিন দিন আগে সাদা পাকা দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধ এসে তাকে ইশারায় কু প্রস্তাব দেন তোকে ভালো কিছু টাকা দিব আমার সাথে চল কিছুক্ষণ থেকে আবার চলে আসবি।

আগামীতে কি করবেন জানতে চাইলে বলেন কিছু টাকা জমিয়ে রুম ভাড়া ৩০০০ টাকা দিয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে গাজীপুর চলে গিয়ে আবার গার্মেন্টসে চাকরি করব কিন্তু তার আগে সন্তানের ও নিজের খাবারের জন্য এক মাসের অর্থ জমিয়ে নিতে চান সে আশায় প্রতিদিন এখানে এসে বসে থাকেন, স্বামী যদি তার কাছে ফিরে আসে আর তার কাছে ফিরবেন কিনা জানতে চাইলে বলেন আমাকে অনেক মারত অনেক নির্যাতন করতো আমি তার কাছে আর ফিরতে চাই না। আমি বেঁচে থাকতে চাই আমার পোলা দুইডা বড় হইয়া আমার সব কষ্ট দূর কইরা দিব, আল্লাহ যেন আমার এই মাসুম দুইটা বাচ্চার লাইগা আমারে বাঁচায়া রাখে।

তানজিলা ও তার দুই সন্তানের ছবি তোলার কথা বলতেই পাঁ জড়িয়ে ধরতে চাইলেন বললেন স্যার আমার আর আমার বাচ্চার ছবি তুইলা না শুধু বাচ্চার দুটো ছবি তোলার অনুরোধ করা হলো তাও সেটা সে প্রত্যাখ্যান করে, অবশেষে তাকে আশ্বস্ত করা হয় তার ও তার সন্তানের কোনো ছবি তোলা হয়নি।

আমাদের এই সমাজে তানজিলার মত এরকম অনেক নির্যাতিত অসহায় নারী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যাদের প্রত্যেকের জীবনের গল্পগুলো ভয়ংকর, বিশেষ করে পড়াশোনা না জানা গ্রামের অসহায় মেয়েগুলোই বেশি নির্যাতিত হচ্ছে ধর্ষিত হচ্ছে।

শিক্ষাবিদদের মতে নারীর শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে এবং বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে হবে নারী যদি আত্মনির্ভরশীল হয় তাহলে সে অসহায় ও নির্যাতিত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম, এবং এই অসহায় নারীদের কল্যাণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে শুধু সরকারি সংস্থাগুলো দায়িত্ব নিলেই হবে না পাশাপাশি বেসরকারি এনজিও সংস্থাগুলো ব্যক্তি বিভিন্ন সংগঠন অসহায় নির্যাতিত নারীদের পাশে দাঁড়াতে হবে , নারীকে আত্মনির্ভরশীল ও দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করতে পারলেই নারীর ক্ষমতায়নের ভিত্তি মজবুত হবে।

আসিফ

×