
একজন সন্তানসম্ভবা নারী শুধু একজন মা নন, তিনি একটি নতুন প্রাণের জন্মদাত্রী। গর্ভকালীন সময় নারীর জীবনে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল সময়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের সমাজে এখনো গর্ভবতী নারীদের অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় উপদেশ, কটূক্তি কিংবা অবহেলার সম্মুখীন হতে হয়। বাংলাদেশে গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের হার কিছুটা বাড়লেও এখনো যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা সমীক্ষা (BDHS) ২০২২ অনুযায়ী, দেশে মাত্র ৪৭% গর্ভবতী নারী পর্যাপ্ত মাত্রায় (অন্তত ৪ বার) গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেন। গ্রামীণ অঞ্চলে এই হার আরও কম। এছাড়া মাতৃমৃত্যুর হার এখনো প্রতি এক লাখ জীবিত জন্মে ১৬১ জন, যা ঝউএ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। হ্নসমাজে এখনো সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে- এ বিষয়টি নিয়ে নানা কুসংস্কার ও মানসিক অত্যাচারের শিকার হন সন্তানসম্ভবা নারীরা। বিশেষ করে পুত্রসন্তানের প্রত্যাশা অনেক পরিবারে একটি চাপের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান BRAC Institute of Governance and Development (BIGD) এর ২০২০ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, ৬৫ শতাংশ নারীই জানান গর্ভাবস্থায় তারা পরিবার থেকে পুত্রসন্তানের প্রত্যাশা সংক্রান্ত মানসিক চাপে ছিলেন। এই চাপে অনেক সময় গর্ভকালীন উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং এমনকি অপুষ্টি পর্যন্ত দেখা দেয়। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (UNFPA) ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, দক্ষিণ এশিয়ার অনেক অংশের মতো বাংলাদেশেও গর্ভাবস্থায় লিঙ্গ নির্ধারণে আগ্রহ ও বৈষম্যের প্রবণতা রয়েছে। যদিও এটি আইনত নিষিদ্ধ, তথাপি গোপনে অনেক স্থানে আল্ট্রাসোনোগ্রাফির মাধ্যমে লিঙ্গ নির্ধারণের চেষ্টা চলে, যা নারী শিশু অধিকার এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। অনেকেই চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনেই সন্তানসম্ভবা নারীকে বিভিন্ন ভুল উপদেশ দেন, যা কখনো কখনো বিপজ্জনকও হতে পারে। কোন খাবার খেতে হবে, কোন দিক মুখ করে শুতে হবে, ছেলে হবে না মেয়ে- এমন নানা ধরনের কুসংস্কার ও অপ্রমাণিত কথা শোনাতে থাকে চারপাশের মানুষ। এতে একজন গর্ভবতী নারীর মানসিক চাপ অনেক বেড়ে যায়। একজন সন্তানসম্ভবার প্রয়োজন চিকিৎসা বিজ্ঞানসম্মত পরামর্শ, মানসিক প্রশান্তি এবং পারিবারিক ও সামাজিক সহযোগিতা। তার শারীরিক পরিবর্তনের প্রতি সহানুভূতি দেখানো, বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া এবং ভালো পুষ্টিকর খাবারের নিশ্চয়তা দেওয়া- এসব দায়িত্ব শুধু পরিবারের নয়, সমাজেরও। গর্ভবতী নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা একটি সভ্য ও মানবিক সমাজের লক্ষণ। যানবাহনে তাদের জন্য বসার ব্যবস্থা রাখা, কর্মস্থলে বিশেষ ছাড় দেওয়া এবং পারিবারিক সহানুভূতি- এসব ছোট ছোট বিষয় তাদের জীবনে বড় স্বস্তি এনে দিতে পারে। আমাদের উচিত সন্তানসম্ভবা নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা, তাদের সম্মান জানানো এবং সকল প্রকার কুসংস্কার থেকে দূরে থাকা। সন্তানসম্ভবা নারীকে সম্মান জানানো মানে হলো ভবিষ্যতের প্রজন্মকে সম্মান জানানো।
লালমাই সরকারি কলেজ, কুমিল্লা থেকে
প্যানেল