
গত দেড় দশকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল নাজুক, যা এখন ইতিবাচক ধারায় ফিরতে শুরু করেছে। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ৮ এপ্রিল প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। প্রথম প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ। অর্থাৎ প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। তবে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধির হার খুব একটা বাড়েনি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে কৃষি, শিল্প ও সেবা সব খাতেই প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। তবে গত অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, কৃষি ও সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি কমেছে, বেড়েছে কেবল শিল্প খাতে। মূলত চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিকে টেনে তুলছে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি। তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, এ ধরনের প্রবৃদ্ধি দরিদ্রবান্ধব নয়। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪ দশমিক ০২ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কৃষি প্রবৃদ্ধি ছিল ০ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
শিল্প খাতে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ১০ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১ দশমিক ০৪ শতাংশ। প্রথম প্রান্তিকে এ খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৪৪ শতাংশ। সেবা খাতে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ, যা প্রথম প্রান্তিকে ছিল ২ দশমিক ৪১ শতাংশ। তবে গত অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এ খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের সাময়িক হিসাব অনুযায়ী, চলতি মূল্যে জিডিপির আকার ১৪ হাজার ৪৩ বিলিয়ন টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপির আকার ছিল ১২ হাজার ৬৭৬ বিলিয়ন টাকা। মূলত শিল্প খাতে ঘুরে দাঁড়ানোর কারণে অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অর্থাৎ শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধিই পুরো প্রবৃদ্ধিকে টেনে তুলেছে।
দেশে-বিদেশে সৃষ্ট নেতিবাচক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি চার ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এগুলো হচ্ছেÑ ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও সরবরাহ পরিস্থিতি বাধাগ্রস্ত হওয়া, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং আর্থিক খাতে অস্থিরতা। দেড় বছর ধরে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগোনোর পর এখন অর্থনীতির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে এসেছে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারের চাপ। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। দেশের সার্বিক অর্থনীতির হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রতি তিন মাস পর এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তৃতীয় প্রান্তিক অর্থাৎ অক্টোবর-ডিসেম্বর ওই তিন মাসের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, এ সময়ে দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
এর আগে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে শ্লথগতির কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ব্যাপকভাবে টান পড়েছিল। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৯৬ শতাংশে নেমেছিল। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় টানা তিন প্রান্তিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পর অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে তা আবার বেড়েছে। বিবিএসের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এবার তা হয়েছে ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ। বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। গত অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। চতুর্থ প্রান্তিকে তা দাঁড়ায় ২ দশমিক ১৪ শতাংশে।
কৃষি, শিল্প ও সেবাÑ এই তিন খাত দিয়ে জিডিপি প্রকাশ করা হয়। অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে কৃষি খাতে। এই খাতের প্রবৃদ্ধি মাত্র ১ দশমিক ২৫ শতাংশ। এরপর সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং শিল্প খাতে ৭ দশমিক ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিবিএসের তথ্য অনুসারে, অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে দেশের ভেতরে স্থির মূল্যে ৮ লাখ ৮৬ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা মূল্যের পণ্য ও সেবা উৎপাদন হয়েছে। আগের প্রান্তিকে যা ছিল ৮ লাখ ৪ হাজার ৯৪২ কোটি টাকার সমান। সে হিসাবে অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে আগের প্রান্তিকের চেয়ে ৮২ হাজার কোটি টাকার বেশি পণ্য ও সেবা উৎপাদন হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বাড়বে, মূল্যস্ফীতির হার কমবে। তবে চলতি বছরে প্রবৃদ্ধির হার কমবে, বাড়বে মূল্যস্ফীতির হার। চলতি অর্থবছরে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ১০ শতাংশে পৌঁছতে পারে। তবে আগামী অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে সাড়ে ৬ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির হার কমে ৫ দশমিক ২ শতাংশে নামতে পারে।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক, এপ্রিল ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। তিন মাস পর পর আইএমএফ এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। সংস্থাটি আগের দেওয়া পূর্বাভাস এবারও অপরিবর্তিত রেখেছে। আইএমএফের ‘গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি’ নামে আরও একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বিশেষ করে বড় বাণিজ্যের দেশগুলোর মধ্যে শুল্কারোপ ও আর্থিক নীতিতে পরিবর্তন আসার কারণে বৈশ্বিকভাবে আর্থিক খাতে নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বসন্তকালীন যৌথ সভা শুরু হয়েছে। সভার দ্বিতীয় দিনে এ দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মন্দার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হয়েছে। ফলে ভোগের প্রবণতা কমেছে। এতে প্রবৃদ্ধির হারও কমবে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ের অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এসব কারণে চলতি অর্থবছরে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ১০ শতাংশে পৌঁছতে পারে। তবে আগামী অর্থবছরের বিষয়ে সংস্থাটি ইতিবাচক আভাস দিয়েছে। এর মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে সাড়ে ৬ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির হার কমে ৫ দশমিক ২ শতাংশে নামতে পারে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ার কারণে এসব খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এর আগে বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয় চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য সংশোধন করে ৫ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। কয়েক দিন আগে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। এডিবির তুলনায় আইএমএফের জিডিপির প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস আরও কম।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত মার্চে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী জুনের মধ্যে এ হার সাড়ে ৮ শতাংশের মধ্যে নামাতে চায়। আইএমএফের নতুন পূর্বাভাস অনুসারে, চলতি বছরে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার কমবে। ২০২৪ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। চলতি বছরে তা কমে দাঁড়াবে ২ দশমিক ৮ শতাংশে। আগামী বছরে প্রবৃদ্ধির হার আবার বেড়ে ৩ শতাংশ হতে পারে। এছাড়া চীনের প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ, ভারতের ৬ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে।
আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী মন্দা মোকাবিলা করে সামনে এগোতে হয়েছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারি, ২০২১ সালে শুরু হওয়া বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির উত্থান এবং ২০২২ সালে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক মন্দা। এর ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই সম্প্রতি অর্থনৈতিক নীতি এবং বিশেষ করে শুল্কারোপ নিয়ে বৈশ্বিক অঙ্গনে আঞ্চলিক অস্থিরতার কারণে আবারও বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থা অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়াও বৈদেশিক ঋণের উচ্চস্তর একটি উদ্বেগের বিষয় হিসাবে এখনো রয়ে গেছে। আর্থিক খাতের ভারসাম্যহীনতা এবং সরকারি ঋণের কারণে স্বল্পোন্নত দেশগুলো বেশ চাপে আছে। শুল্কনীতির কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্যে যে অস্থিরতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে তাতে আর্থিক ভারসাম্যহীনতার প্রতিকূল প্রভাবগুলো আগামীতে আরও বেড়ে যেতে পারে বলে প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা ইতিবাচক অবস্থায় এগোচ্ছে।
লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন
প্যানেল