
গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর
৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে যে রিজার্ভ ২০ বিলিনিয়নে নেমে এসেছে, তা ৪০ বিলিয়নে উন্নীত করতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ জন্য অর্থনীতিকে গতিশীল করতে হবে। আগামী মাসে রিজার্ভ হবে ২৭-৩০ বিলিয়ন ডলার। এই রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারে নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, যার জন্য সময় প্রয়োজন।
বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এসব কথা বলেন।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান জাইদি সাত্তার। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিআরআইয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. হাবিবুর রহমান।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ২০২৪ সালের হিসাবে ব্যাংকিং ব্যবস্থার মোট আমানতের প্রায় ৪২ শতাংশ মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ ব্যাংক হিসাবধারীর কাছে আছে। তাঁদের প্রত্যেকের হিসাবে ১ কোটি টাকা বা তার বেশি অর্থ জমা আছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এর তথ্যমতে, আমানত দুটি জেলায় - ঢাকা এবং চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে কেন্দ্রীভূত, যা একসঙ্গে দেশের মোট আমানতের ৩৫ শতাংশেরও বেশি। শুধু আমানতই নয়, ব্যাংকিং খাতে ঋণও এই দুটি জেলায় কেন্দ্রীভূত। মাত্র ১.২ শতাংশ ঋণ অ্যাকাউন্টে ১ কোটি টাকা বা তার বেশি বকেয়া রয়েছে, তবু এগুলো মোট ঋণের প্রায় ৭৫ শতাংশ, পিআরআই জানিয়েছে, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে মোট ঋণের প্রায় ৪০ থেকে ৪২ শতাংশ শিল্প খাতে গিয়েছিল, যেখানে কৃষি খাতে ঋণ কম ছিল, একই সময়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে ছিল।
পিআরআইয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান বলেন, এই তথ্য ইঙ্গিত দেয় বাংলাদেশের সম্পদ ব্যাপকভাবে পুঞ্জীভূত হয়েছে। দেশের খুব অল্পসংখ্যক মানুষের হাতে সম্পদের বড় অংশ আছে।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দুর্ঘটনাকবলিত অর্থনীতি পুনর্গঠনে দরকার অর্থনৈতিক বিপ্লব। এজন্য জুলাই বিপ্লবকে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে। দূর করতে হবে অর্থনৈতিক বৈষম্য। আনুষ্ঠানিক খাতে আর্থিক কর্মকা- পরিচালিত হলে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে। এজন্য ক্যাশলেস লেনদেন বাড়াতে হবে।
গভর্নর বলেন, জুলাই বিপ্লবকে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের সবকিছুর গুণগত মান রক্ষা করতে হবে। একবার যেটা হয়েছে সেটা যেন আর না হয় সেটার দিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং শিক্ষা নিতে হবে। আমরা যদি ভুল শিক্ষা নিই তাহলে আরও বড় খেসারত দিতে হবে। এই শঙ্কাটা আমাদের সবার মধ্যে আছে। এমনকি জনগণের মধ্যেও আছে।
আমরা চাই না আবার সেই পথে হাঁটি। আমাদের আংশিকভাবে পুনর্গঠিত একটা অর্থনীতি নির্বাচিত সরকারের হাতে তুলে দিতে হবে। যেটাকে পরবর্তী সরকার আরও সুন্দরভাবে সামনের দিকে নিয়ে যাবে। এটা আমাদের প্রত্যাশা। আশা করছি আমরা সামনের দিকে যেতে পারব। আমাদের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করতে পারব।
গভর্নর বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার এটি পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক সরকারকে এর বাধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। বিপ্লবকে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে, তাহলে অর্থনৈতিক বিপ্লব সম্ভব হবে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় সেদিকে সবাইকে নজর রাখতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
গভর্নর বলেন, আমাদের একটা শক্ত ভিত্তির ওপর ব্যাংকিং খাত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমি সবাইকে সর্বোচ্চ মানে সেবা ও সাপোর্ট দিতে পারব। সেই লক্ষ্যে কাজ করছি। আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। আমরা কেবল শুরুতে আছি। আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছিলাম। অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেই দুর্ঘটনা থেকে একটা সুস্থ জীবনে ফিরতে সময় দিতে হবে। সেই প্রক্রিয়ায় আমরা আছি। সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে। রাজনৈতিক সরকারকেও এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
আর্থিক বৈষম্য দূর করার তাগিদ দিয়ে গভর্নর বলেন, একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষ সিংহভাগ ঋণ পাচ্ছে। এ বৈষম্য দূর করতে এজেন্ট ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এমএফএস এবং এজেন্ট ব্যাংক স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ করলে ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। বাধ্য হয়ে তারাও সুদের হার কমাবে।
‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে আরও বেশি মহিলা ব্যাংকিং এজেন্ট নিয়োগ করতে উৎসাহিত করছে, যারা গ্রামীণ পরিবারগুলিতে আরও কার্যকরভাবে প্রবেশ করতে পারবেন এবং পারিবারিক সঞ্চয়কে আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আনতে সহায়তা করতে পারবেন,’। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে এজেন্ট ব্যাংকগুলো গ্রামীণ ক্লায়েন্টদের ঋণ প্রদান শুরু করলে, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির কারণে ক্ষুদ্র ঋণের সুদের হার স্বাভাবিকভাবেই হ্রাস পাবে।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আনিস উর রহমান, পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক খুরশিদ আলম ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান।