ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৪ মে ২০২৫, ৩১ বৈশাখ ১৪৩২

শিশুর জন্য চাই যথাযথ পুষ্টি

মো. তানজিমুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১৯:৩৬, ১৪ মে ২০২৫

শিশুর জন্য চাই যথাযথ পুষ্টি

‘আগে চাই যথাযথ পুষ্টি, তবেই তো সমৃদ্ধশীল জাতি’- এটি যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাক্য তা সবাইকে যেমন বিশ্বাস করতে হবে, ঠিক তেমনি এ ব্যাপারে গণমানুষকে সংবেদনশীল করে তুলতে হবে। গণসচেতনতার ক্ষেত্রে প্রতিটি স্কুলের শিক্ষকমণ্ডলী, অভিভাবক, স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটি (এসএমসি), শিক্ষক-অভিভাবক সমন্বয় কমিটির (পিটিএ) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রয়োজনীয় আইসি/বিসিসি পোস্টার, লিফলেট বিতরণ, সচেতনতামূলক প্রচারণাসহ উঠান বৈঠক, মা/অভিভাবক সমাবেশ, বিষয়ভিত্তিক রচনা প্রতিযোগিতা আয়োজন করার মধ্য দিয়ে প্রত্যেকেকে পুষ্টি জ্ঞানসম্পন্ন করে গড়ে তোলা সম্ভব। নবদম্পতি ও স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আদর্শ ও ইতিবাচক অভিভাবকত্বের জন্য প্রয়োজনীয় সংলাপের আয়োজন করা যেতে পারে। কেননা, কেবল শুধু অপুষ্টির কবলে প্রতি বছর বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু প্রায় প্রতি হাজারে ৩১ জন এবং এক বছরের কম শিশু প্রায় প্রতি হাজারে ২৫ জন শিশুর অকালমৃত্যু ঘটে (তথ্যসূত্র: বিডিনিউজ ২৪.কম)! যদিও বাংলাদেশে শিশু অপুষ্টির হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, কিন্তু শিশুর প্রতি সহিংস আচরণ সেভাবে কমেনি (ইউনিসেফ)। অতএব খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি শিশুর প্রতি ইতিবাচক আচরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়! বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুর দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টিহীনতার ফলই হচ্ছে খর্বাকৃতি শিশু। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, ৫ বছরের নিচে ২৪ শতাংশ শিশু খর্বকায়। এছাড়া প্রতি বছর দেশে ৫ লাখ ৭৩ হাজার জন প্রিম্যাচিউরড বা অপরিণত শিশু জন্মগ্রহণ করে, যা মোট জন্ম নেওয়া শিশুর শতকরা ১৯ দশমিক ১ শতাংশ। অপরিণত ও অল্প ওজনের শিশুদের মধ্যে ২২ শতাংশ শিশু অনূর্ধ্ব ৫ বছরে মারা যায়। বাংলাদেশে প্রতি ১০ শিশুর মধ্যে ৪ শিশুরই কম ওজন নিয়ে জন্ম নেয় যা পুরো বিশ্বে দ্বিতীয়। এমনকি অপরিণত শিশুর জন্মের ক্ষেত্রে শীর্ষে বাংলাদেশ এবং কম ওজনের ক্ষেত্রে বিশ্বে দ্বিতীয়; যার অন্যতম কারণ মা ও শিশুর অপুষ্টি! যা একটি উন্নয়নশীল দেশে কোনোভাবেই কাম্য নয়।
বর্তমান বিশ্বে ২০২৫ সালটি প্রতিটি শিশুর পুষ্টির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। এটি একদিকে যেমন জাতিসংঘের পুষ্টি বিষয়ক দশকের কর্মকাণ্ডের শেষ বছর, একই সঙ্গে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার’ বিশ্বব্যাপী পুষ্টির লক্ষ্যমাত্রা পুনরায় নবায়নের শেষ বছর। পৃথিবীজুড়ে উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশনসহ সমমনা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ দ্বারা আয়োজিত পুষ্টি বিষয়ক সংলাপগুলো অতি সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে, বিশেষ করে শিশু এবং তরুণদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ব্যপকভাবে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী পুষ্টির ব্যাপকতা ছড়িয়ে দিতে ‘গ্লোবাল মে মোমেন্ট’ নামক এক বিশেষ প্রচারাভিযান চালানো হচ্ছে। স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নীতিনির্ধাকদের পুষ্টি বিষয়ক প্রয়োজনীয় প্রতিশ্রুতিগুলোকে প্রভাবিত করার জন্য আমাদের সমন্বিত অ্যাডভোকেসি উদ্যোগ, প্রচেষ্টা এবং উৎসাহ বৃদ্ধি করা খুবই জরুরি। ফলে শিশুর খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা এবং অপুষ্টির অবসানের জন্য সহযোগী ব্যক্তি/ প্রতিষ্ঠানের একত্রিত উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।
দেহের পুষ্টির জন্য আমরা খাদ্য গ্রহণ করি যার মাধ্যমে শরীরকে সুস্থ-সবল রেখে কর্মক্ষম জীবন যাপন করা যায়। এ কারণেই খাদ্য তালিকায় সুষম খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই। সুষম খাদ্য মানেই যে বেশি দামি খাবার হতে হবে, বিষয়টি কিন্তু তেমন নয়! কোন মৌসুমে কি কি খাবারের অধিক গুরুত্ব রয়েছে সেটি বুঝতে অনেকেই ভুল করে বসি। আমাদের বয়স, ওজন, লিঙ্গ, শারীরিক কার্যকলাপের মাত্রা এবং আরও অনেক কিছু বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ পুষ্টি নিশ্চিত করা উচিত। তথ্য ও জ্ঞানের অভাবে আমাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব যেমন শারীরিক ক্ষতির কারণ হতে পারে, ঠিক তেমনি অতিরিক্ত পুষ্টিও কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য বিপরীত হতে পারে। সুতরাং সকলের জন্য সবার আগে প্রয়োজন যথাযথ পুষ্টি সম্পর্কিত জ্ঞান। তবেই আমরা সমৃদ্ধশালী জাতি হিসেবে স্বপ্ন দেখতে পারি!
বাংলাদেশের মতো উন্নয়ন দেশের সিংহভাগ মানুষের সবজি নির্ভর খাদ্যাভ্যাস হওযা উচিত। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী মানুষের মাঝে স্বাস্থ্য  সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য তালিকায় সবজির গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের শর্করা নির্ভর খাদ্যাভাস কিছুটা পরিবর্তন করে খাদ্য তালিকায় বৈচিত্র্যময় (নানা রঙের) পাতাজাতীয় ও ফল মূলজাতীয় সবজিকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। যেহেতু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে অপুষ্টি একটি অন্যতম  প্রধান সমস্যা, তাই খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে পুষ্টিনিরাপত্তার কার্যকরভাবে সংযোগ ঘটানোটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেক্ষেত্রে পুষ্টি সমৃদ্ধ সুষম খাবারের নিশ্চয়তা দিতে বৈচিত্র্যময় দানাজাতীয় ও ফলমূল জাতীয় খাবারের জন্য ফসল উৎপাদন অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
বর্তমানে পুষ্টি নিরাপত্তা ও খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি সমানভাবে ভাবাচ্ছে। কোনো এক সময় খাদ্যনিরাপত্তা মানে প্রয়োজন অনুযায়ী ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাবারের প্রাপ্যতাকেই বোঝানো হতো। পুষ্টির বিষয়টি তখন সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হতো না। কিন্তু বাস্তবে সমানভাবে পুষ্টিরনিরাপত্তা ও খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমনÑ খাদ্যের প্রাপ্যতা, খাদ্যের সহজলভ্যতা এবং খাদ্যের পুষ্টিমান ও প্রয়োজনীয় গুণাগুণ। এই সামগ্রিক বিষয়টিকে এগিয়ে নিতে হলে স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু জাতীয় পর্যায়ে পুষ্টি বিষয়ে শিশু, যুবক এবং কমিউনিটির কণ্ঠস্বরকে জোরদার করতে হবে। ক্ষুধা ও অপুষ্টি মোকাবিলার জন্য সাধারণ জনগণের কথোপকথনকে আরও ত্বরান্বিত করতে হবে। এমনকি স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারকদের ইতিবাচকভাবে  প্রভাবিত করে এমন কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে যাতে গণমানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে  খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টিনিরাপত্তার বিষয়টি আরও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। সর্বোপরি শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বিষয়ক প্রচারণাকে এগিয়ে নিতে খাদ্য ও পুষ্টিবিষয়ক নীতিনির্ধারকদের স্বাক্ষরিত লিখিত আদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা প্রত্যেকেই জানি, স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। একটি দেশের আপামর জনসাধারণ সুস্থ না হলে জাতীয়ভাবে সমৃদ্ধি বয়ে আনা কখনোই সম্ভব নয়। অতএব এ মুহূর্তে স্কুলগামী সব শিক্ষার্থীকে সুস্থভাবে গড়ে তুলতে খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টিনিরাপত্তার যেমন গুরুত্ব রয়েছে, ঠিক তেমনি সরকারের দায়িত্বও রয়েছে। প্রতিটি স্কুলে সম্ভব হলে সব শিক্ষার্থীর (নিদেন পক্ষে অন্তত গরিব ও অসহায় শিক্ষার্থীদের) জন্য স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন (স্কুল ফিডিং প্রকল্প ২০২৫-২৭) করা। খাদ্য তালিকাগত বৈচিত্র্য বৃদ্ধির জন্য প্রক্রিয়াজাত খাবারের পরিবর্তে রান্না করা খাবার বাস্তবায়নের জন্য সরকারের তরফ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করা। এছাড়া সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে পুষ্টি সমন্বয় কমিটির কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা ও  দৃষ্টান্তমূলক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
আমরা যদি সত্যিই সমৃদ্ধশীল জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চাই, সকল বয়সে সকল ক্ষেত্রে যথাযথ পুষ্টি নিশ্চিতকরণের কোনো বিকল্পই নেই। স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে ফলপ্রসূ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একটি বিশেষ প্রচারাভিযান চালিয়ে যেতে হবে, যা সকলের পুষ্টি বিশেষ করে মা ও শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখবে এবং তাঁদের চাহিদাকে সর্বদাই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। এমনি করেই প্রতিটি শিশুর সার্বিক উন্নয়ন সাধিত হবে। ফলে জাতীয় উন্নয়নে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে সন্নিকটে! সেক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে সবার আগে চাই যথাযথ পুষ্টি। তবেই তো সমৃদ্ধ জাতি!
লেখক : কো-অর্ডিনেটর, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ
[email protected]

প্যানেল

×