
.
নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় এক সময়ের জনপ্রিয় একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অল্প টিউশন ফি আর শিক্ষা সেবার কারণে মধ্যবিত্তের পছন্দ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। তবে এখন ভার্সিটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রশি টানাটানি চলছে। প্রতিষ্ঠাকালীন ট্রাস্টি সদস্যরা বলছেন, ২০১১ সালের পট পরিবর্তনের পর বিশ্ববিদ্যালয়টি বেদখল হয়ে যায়। আবার ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর এই বিশ্ববিদ্যালয়টির ওপর হামলা ও নতুন করে বেদখলের অভিযোগও করেছে বর্তমান ট্রাস্টি বোর্ড। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বলছে, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুটি পক্ষই বেশ সোচ্চার। তারা যেভাবে কথা বলছে ও যুক্তি উপস্থাপন করছে তাতে খোদ ইউজিসিই সংশয়ে পড়েছে।
জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এস এম এ ফায়েজ জনকণ্ঠকে বলেন, দুই পক্ষের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। এটি চলতে পারে না। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ইউজিসিতে ফুল কমিশন সভা হবে। সেখানেই এই বিষয়ে সম্পূর্ণ সুুরাহা হবে। আমি শুধু এটুকু নিশ্চিত করতে পারি সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতার সঙ্গে সমাধান করবে কমিশন। জানা যায়, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয় ২০০২ সালে। প্রতিষ্ঠা করেন আবু বকর সিদ্দিক। সে বছরই শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদন দেয়। দ্রুত জনপ্রিয়তার কারণে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নয়টি প্রতিষ্ঠান গঠন করে। এরমধ্যে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়, নর্দান মেডিক্যাল কলেজ, নর্দান কলেজ অন্যতম। সেসময় সাত সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ডে ছিলেন প্রফেসর মো. শামসুল হক, মো. আবু বকর সিদ্দিক, আবু আহমেদ, মো. লুৎফর রহমান, মো. বোরহান উদ্দিন, আয়েশা আক্তার, মো. রেজাউল করিম। কিন্তু ২০১১ সালে ক্ষমতার পালাবদলে বদলে যায় নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ। অভিযোগ রয়েছে, প্রফেসর ইউসুফ আব্দুল্লাহর সঙ্গে এই সাত ট্রাস্টি সদস্য চুক্তিতে আবদ্ধ হন। চুক্তির প্রধান শর্ত ছিল ব্যাংকের দেনা শোধ
ও (সিআইবি) ক্লিয়ারেন্স।
শর্ত হিসেবে এই ট্রাস্টি বোর্ডে যুক্ত হবেন ইউসুফ আব্দুল্লাহ। সেই সময়ের ট্রাস্টি সদস্য মো. বোরহান উদ্দিন অভিযোগ করে জনকণ্ঠকে বলেন, দায় দেনা পরিশোধ না করে ইউসুফ আব্দুল্লাহ আলাদা একটি ট্রাস্টিবোর্ড গঠন করেন। যার সব সদস্যই ছিল তার নিকট আত্মীয়। এরপর পুরাতন ট্রাস্টিদের বের করে তিনি প্রতিষ্ঠানটি দখল করেন। তৎকালীন সময় এই ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় একটি জিডি করার ঘটনাও ঘটে। বোরহান উদ্দিন জানান, সেই সময় আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ভার্সিটি পরিচালনা করে আসছেন। সর্বশেষ ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের পর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে আবেদন করেন। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) একটি তিন সদস্যের কমিটি করে দেয়। কিন্তু কমিটির সদস্যদের নিয়ে অধ্যাপক ইউসুফ আব্দুল্লাহদের আপত্তি থাকায় নতুন কমিটি গঠন করে ইউজিসি। এরপর আবারও নতুন করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়। সেখানে আহ্বায়ক করা হয় সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অব) মো. আলতাফ হোসেনকে।
সদস্য হিসেবে ছিলেন, ইউজিসি উপপরিচালক নাসিমা আক্তার খাতুন এবং সদস্য সচিব হিসেবে ছিলেন সিনিয়র সহকারী পরিচালক সেজুতি আকবর। কিন্তু তাদের রিপোর্ট প্রদানের পর বর্তমান ট্রাস্টিরা আদালতে রিট করেছেন। এ বিষয়ে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রার মো. মোস্তফা শহীদ জনকণ্ঠকে জানান, আমি এক বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। যা বলছি সেটা জেনে ও শুনে বলছি। নর্দান ভার্সিটি আইবেট ট্রাস্টের মাধ্যমে পরিচালিত হত। এখনো সেভাবেই হচ্ছে। ওই সময় সমস্যা যেটা হয়, বিভিন্ন সময়ে ভার্সিটিকে দেখিয়ে প্রচুর ব্যাংক ঋণ নেওয়া হয়। যা ট্রাস্টিরা ভাগ করে নেন। পরে ২০১০ সালে সরকার যখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা নীতিমালা তৈরি করে, তখন স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আগের ট্রাস্টিরা বিনিয়োগে ব্যর্থ হন। পরে ২০১১ সালের ২৭ জুলাই মো. বোরহান উদ্দিন, লুৎফর রহমান সানী পদত্যাগ করেন এবং তারা তাদের প্রাপ্য হিস্যা নিয়ে যান। যার রেকর্ডও আছে। একই সঙ্গে অধ্যাপক ইউসুফ আব্দুল্লাহ সব ঋণ পরিশোধ করেছেন বলেও দাবি করেন এই রেজিস্ট্রার। বর্তমান নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ২ দিনের মাথায় হামলা হয় নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ে। বোরহান উদ্দিন ও লুৎফর রহমান সানি নামের দুজন নেতৃত্ব দেয় এই হামলায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে জিম্মি করে বিশ্ববিদ্যালয় দখরের চেষ্টা করেন তারা। এসব ছাত্ররা প্রতিহত করে এবং পরে সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। গ্রেপ্তার করা হয় বোরহান ও সানিকে। মামলা হয় তাদের নামে। এর কিছুদিনের মাথায় বনানীর প্রাসাদ ট্রেড সেন্টারে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসে ভাঙচুর চালানো হয়। অফিস লুট করা হয়।
এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যানসহ ট্রাস্টি বোর্ডের প্রায় সবার নামে জুলাই আগস্টের হত্যা মামলায় আসামি করেছে তারা। তাদের অভিযোগ গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকার পতনের পর থেকে এখন অবৈধভাবে মামলা দিয়ে ও হামলা চালিয়ে দখলের চেষ্টা করছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। শুধু হামলা ও মামলা করেই ক্ষান্ত হয়নি এই চক্রটি। নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর সামসুল হকের থেকে বিশ্ববিদ্যালয় দখলের জাল দলিল সই করাতে চেয়েছিল তারা। এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগও করা হয় বনানী থানায়। এ ঘটনাও পুলিশ দুজনকে খুঁজছে। হামলার বিষয়ে বোরহান উদ্দিনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তাদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের হামলা চালানো হয়নি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কথা বলতে ডেকেছিল। তবে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা ও জেলে যাওয়ার সত্যতা স্বীকার করেন তিনি।
প্যানেল