
কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা এদেশ-ওদেশ সব দেশেই রয়েছে বলা যায়। তবে পাশ্চাত্যে কর ফাঁকি দেওয়া সহজ নয় কর আদায়ের পদ্ধতির কারণে। কিন্তু বাংলাদেশে যাদের কর প্রদানের সামর্থ্য রয়েছে তারাই কর ফাঁকি দিতে সিদ্ধহস্ত বলে প্রচার রয়েছে অনেককাল ধরেই। তবে কর প্রদান পদ্ধতি ক্রমেই সহজ করে আনায় কর প্রদানে উৎসাহী হয়ে উঠছে করদাতারা। তাই দাতার সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী নাগরিকদের কর ফাঁকি প্রতিরোধ করার গতি স্তিমিত প্রায়। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা-সমালোচনা হলেও অদ্যাবধি টেকসই কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর।
বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী নাগরিকদের কর ফাঁকি রোধে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতায় তাতে ভাটা পড়েছে। ফলে এত বছরেও বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী নাগরিকদের বিশ্বাসযোগ্যভাবে চিহ্নিত করা, বৈধ-অবৈধ কর্মরত বিদেশী নাগরিক নির্ধারণ, তাদের প্রকৃত আয়, নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ফলে প্রকৃত আয়কর আদায় করাও সম্ভব হচ্ছে না। এই ব্যর্থতা একান্তই এনবিআরের। যদিও তারা বলছে এমন পরিস্থিতিতে বিদেশী কর্মীদের আয়কর বিষয়ে সচেতন করতে ‘লিফলেট’ বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে। বিমানবন্দর, স্থলবন্দর ছাড়াও বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলোতে আয়কর বিষয়ে সম্যক ধারণা দিতে এ লিফলেট বিতরণ করা হবে।
বিদেশীদের কর ফাঁকি রোধে এই পদ্ধতি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে এমনটা কারও কাছেই বিশ্বাসযোগ্য বলে প্রতীয়মান হবে না। দেশে বিদেশী নাগরিকদের প্রকৃত সংখ্যা চিহ্নিত করা যায়নি অদ্যাবধি। অথচ তিন বছর আগে তাদের সংখ্যা চিহ্নিত ও তাদের কাছ থেকে প্রযোজ্য কর আদায় করতে এনবিআর ‘শক্তিশালী টাস্কফোর্স’ গঠন করেছিল। এই টাস্কফোর্স কর ফাঁকিবাজ বিদেশী নাগরিকদের চিহ্নিত করতে কিছু কার্যক্রম নিয়েছিল। বিদেশী নাগরিক কাজ করে এমন ২৮৬ প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিতও করা হয়েছিল। এছাড়া তাদের কর ফাঁকি ধরতে সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে বিমানবন্দর ত্যাগকালে আয়কর সনদ দেখানোর বাধ্যবাধকতা আরোপ করে কর বিভাগ। এ লক্ষ্যে দেশের চারটি বিমানবন্দরে এ সংক্রান্ত ডেস্ক চালুর পর কয়েকজন কর ফাঁকিবাজ বিদেশী নাগরিককে চিহ্নিতও করা হয়। শুধু তাই নয়, তাদের কাছ থেকে এ প্রক্রিয়ায় কয়েক কোটি টাকা আয়করও আদায় করা হয়েছিল। এ পর্যন্ত দেশে কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী বিদেশী করদাতার সংখ্যা মাত্র ১২ হাজার ৪২১ জন। অন্যদিকে ইমিগ্রেশন র্কর্তৃপক্ষের হিসাবে ওয়ার্ক পারমিট গ্রহণকারী বিদেশী নাগরিকের সংখ্যা সাত হাজারের সামান্য বেশি। অথচ দেশে কয়েক লাখ বিদেশী নাগরিক কাজ করে বলে ধারণা করা যায়।
বিশেষত গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল কারখানা, বায়িং হাউস, এনজিও, বহুজাতিক কোম্পানি, অবকাঠামো নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কয়েক লাখ বিদেশী কাজ করে। অথচ তাদের প্রকৃত সংখ্যা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। তাদের বেতনের প্রকৃত অঙ্কও গোপন করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বর্তমান নিয়মে দেশে কোনো বিদেশী নাগরিক তিন মাস অবস্থান করলে তার কর ফাইল খুলতে হয়। অনেক বিদেশী নাগরিক কর ফাঁকি দেয়ার উদ্দেশ্যে তিন মাসের ঠিক আগে বাংলাদেশ ত্যাগ করে আবার ফেরত আসেন। অনেকে বছরের পর বছর পার করলেও এ প্রক্রিয়ায় কর এড়িয়ে যাচ্ছেন অনেকে। এনবিআরের উচিত আলস্য ও উদাসীনতা এবং কর্তব্যে অবহেলা না করে সক্রিয়ভাবে তৎপরতা চালিয়ে কর আদায়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা। দেশের অর্থ রাজস্ব প্রদান ছাড়া বিদেশে নিয়ে যাওয়া অর্থ পাচারের সমতুল্য। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে দরকার বাস্তব পদক্ষেপ।
নিবন্ধনের বাইরে প্রায় ছয় লাখ বিদেশী নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করছেন। তাদের নিবন্ধনের আওতায় আনা গেলে বছরে কমপক্ষে দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১৮ হাজার কোটি টাকা বাড়তি কর আদায় হতে পারে। এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় এই বিশাল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এছাড়া বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ করতে বিদ্যমান স্বর্ণ নীতিমালা সংশোধনসহ একগুচ্ছ প্রস্তাব দিয়েছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। প্রতিবেদনে দেশের সংকটময় অর্থনীতির নানা দিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সংস্থাটি মনে করছে অর্থ পাচারের পেছনে বিদ্যমান স্বর্ণ নীতিমালার ফাঁকফোকর অনেকটা দায়ী। কারণ এ নীতিমালার অধীনে বিদেশ থেকে স্বর্ণের বার ও অলঙ্কার আনার ক্ষেত্রে অপব্যবহার হচ্ছে। এক্ষেত্রে স্বর্ণ নীতিমালা সংশোধন চেয়েছে সংস্থাটি। তাদের মতে, বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ ও ডলার সংকট কাটাতে পর্যটকদের মাধ্যমে সোনার বার আনা বন্ধ বা সীমিতকরণ এবং করমুক্ত স্বর্ণ ও অলংকার ১০০ গ্রামের পরিবর্তে সর্বোচ্চ ৭৫ গ্রাম নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি একজন যাত্রী বছরে দুবারের বেশি ব্যাগেজ রুলের সুবিধা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখানে অবৈধ লেনদেন ও মানি লন্ডারিং কমাতে ব্যক্তি পর্যায়ে বছরে ৫০ লাখ টাকার বেশি নগদ উত্তোলনের ক্ষেত্রে এক শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনেরও সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এছাড়াও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমাতে ‘অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি’ গঠন ও বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ, বেনামি ঋণের নামে জালিয়াতি বন্ধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) ডাটাবেস চালু, সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন, বৈদেশিক ঋণনির্ভর প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছে সংস্থাটি।
জুনের প্রথম সপ্তাহে অন্তর্র্বর্তী সরকার প্রথম বাজেট (২০২৫-২৬) ঘোষণা করতে যাচ্ছে। সম্ভাব্য ৭ লাখ ৯০ হাজার হাজার কোটি টাকার নতুন বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা ধরে কাজ করছে অর্থ বিভাগ। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ একটি কঠিন সংকটময় অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এ বাজেট দেবেন। এজন্য অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, বাজেট হবে বাস্তবমুখী, উচ্চাভিলাষী নয়।
অর্থনীতির সংকট কাটাতে যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে এবং কয়েকটি অগ্রাধিকার খাত তুলে ধরে বিশ্লেষণধর্মী প্রস্তাব করেছে গোয়েন্দা সংস্থাটি। সেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, কর ও ভ্যাট-জাল সম্প্রসারণ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নয়ন, উৎপাদনশীল খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধি, এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি, দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
আইএমএফের ঋণের শর্তপূরণে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত রাজস্ব আহরণ করতে গিয়ে সরকার অনেকটা গলদঘর্ম হয়ে পড়েছে। এতে ঋণের কিস্তি পাওয়া, না পাওয়া নিয়ে সরকার এবং দাতা সংস্থা আইএমএফের মধ্যে দূরত্ব দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থা আগামী বাজেটে অতিরিক্ত দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ ১৮ হাজার কোটি টাকা আদায়ের রূপরেখা দেওয়ার পর অর্থ মন্ত্রণালয় এ নিয়ে পর্যালোচনা করছে। অর্থ উপদেষ্টার কাছে পাঠানো সংস্থাটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ব্যাংক খাতের অনিয়ম, ঋণ কেলেঙ্কারি, ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভ পতনের মতো নানা সংকটের মধ্য দিয়ে বিগত কয়েকটি অর্থবছর অতিবাহিত হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি সংকটে শিল্পের উৎপাদন ও নতুন বিনিয়োগে স্থবিরতা ছিল উল্লেখযোগ্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বিশেষ করে জুলাই বিপ্লবের পর অর্থনীতির গতি অনেকটা মন্থর হয়ে পড়ায় এর প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আহরণে।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রমিক বিক্ষোভের ফলে পণ্য উৎপাদন, সরবরাহ ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়ছে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পাল্টাপাল্টি শুল্কারোপকে কেন্দ্র করে বাণিজ্য যুদ্ধ পাশাপাশি বৈশ্বিক মন্দার শঙ্কাও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনায় নিয়ে আগামীতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও কার্যকরী বাজেট প্রণয়ন করা আবশ্যক।
এনবিআরে আয়কর রিটার্ন এবং ঋণ নেওয়ার সময় ব্যাংকের কাছে দেওয়া সম্পদ বিবরণীর তথ্যে বিস্তর ফারাক থাকে। অসাধু ব্যবসায়ীরা ড্রাইভার, দারোয়ান ও অফিস সহায়কসহ বিভিন্ন জনের নামে ব্যবসা দেখিয়ে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত বেনামি এই ঋণ আর আদায় হয় না। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদনের আগে এনবিআরের নির্দিষ্ট ডাটাবেস থেকে ব্যবসায়িক তথ্য নেওয়া বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এতে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়বে আর ফাঁকিও রোধ হবে।
লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন
প্যানেল