ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৪ মে ২০২৫, ৩১ বৈশাখ ১৪৩২

নদীশাসন ও নদীর যত্ন

মোহাম্মদ নুর হোসেন নয়ন

প্রকাশিত: ১৯:৪১, ১৪ মে ২০২৫

নদীশাসন ও নদীর যত্ন

বাংলাদেশ- এক নদীমাতৃক ভূখণ্ড। এ দেশের মানচিত্র যেমন নদীর আঁকাবাঁকা রেখায় গঠিত,  তেমনি এর অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও জনজীবনের গতিপথও নদীনির্ভর। শস্যভাণ্ডার, মাছের জোগান, পণ্য পরিবহন, যাত্রী চলাচল- সবকিছুতেই নদীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। শত শত বছর ধরে গ্রামীণ জনপদ থেকে নগর পর্যন্ত জীবনের ছন্দ ছিল নদীকেন্দ্রিক। কিন্তু আজ এই নদীগুলো চরম সংকটে। দখল, দূষণ, অতিরিক্ত চাপ ও অব্যবস্থাপনায় একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেশের অমূল্য নৌপথগুলো। এই পরিস্থিতিতে ‘নৌনিরাপত্তা সপ্তাহ’ কেবল একটি কর্মসূচি নয়- এটি হওয়া উচিত একটি জাতীয় সচেতনতা সৃষ্টি করার মুহূর্ত।  কেননা,  নৌযান বা যাত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে, আমাদের প্রথমেই নিশ্চিত করতে হবে নদীর নিরাপত্তা। একথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না  যে, একটি দূষিত, ভরাট ও ক্ষতিগ্রস্ত নদীতে  কোনো উন্নত প্রযুক্তি বা আধুনিক নৌযানই নিরাপদে চলতে পারে না।
বর্তমানে দেশের অধিকাংশ নদীরই অবস্থা করুণ। বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলী, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা কিংবা সুরমার পানিতে নামলেই  চোখে পড়ে কালো জল, ভাসমান বর্জ্য, কচুরিপানা, রাসায়নিক আবর্জনা আর মৃত প্রাণীর  দেহাবশেষ। এসব নদীপথে নৌযান চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পানির স্বচ্ছতা ও প্রবাহ বাধাগ্রস্ত, নদীগর্ভে পলি জমে নৌপথ অগভীর হয়ে ঝড়েছে। যার ফলে প্রতিনিয়ত ঘটে দুর্ঘটনা- ট্রলার ডুবি, যাত্রী হতাহত,  নৌযান বিকল হয়ে পড়া- এ  যেন এক চলমান দুর্ভোগ। অনেকেই ভাবেন, লাইফ জ্যাকেট, রাডার বা চালকের দক্ষতা হলেই নৌনিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, যত উন্নত প্রযুক্তি থাকুক না  কেন, যদি নদীটাই দূষিত, সরু বা ভরাট হয়ে যায়, তাহলে নিরাপদ নৌচলাচল সম্ভব নয়। দূষণের ফলে নদীতে দৃষ্টিসীমা কমে যায়, পানির নিচে লুকিয়ে থাকে বিপজ্জনক বস্তু, যা দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। এমনকি পানিতে  তেল বা রাসায়নিক মিশে গেলে ইঞ্জিন পর্যন্ত বিকল হয়ে যেতে পারে। কাজেই প্রযুক্তির পাশাপাশি চাই দূষণমুক্ত, গভীর, প্রবহমান ও জীবন্ত নদী। নদীর দখলমুক্তি, নিয়মিত ড্রেজিং ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব। নদী রক্ষা কমিশন, বিআইডব্লিউটিএ, স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় গড়ে তুলতে হবে। ছোট ছোট নদীঘাট, গ্রামীণ নৌপথ, কৃষিপণ্য পরিবহনের সুযোগ- সবই আবার সচল করতে হবে। ২৪ হাজার কিলোমিটার সম্ভাবনাময়  নৌপথের মধ্যে মাত্র ৬ হাজার ব্যবহৃত হচ্ছে- এই ব্যবধান দূর করতেই চাই সুস্থ নদীপথ। এতে গ্রামীণ অর্থনীতি  যেমন বাঁচবে, এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনার হারও কমবে।
নদী রক্ষায় চাই কঠোর আইন প্রয়োগ, জনগণের সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন। ২০১৩ সালের নদী রক্ষা আইন বাস্তবায়নে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। যারা নদী দখল বা দূষণের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে  জোরালো ব্যবস্থা নিতে হবে। স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে নদী রক্ষাবিষয়ক অধ্যায় যুক্ত করা, স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, গণমাধ্যম ও তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ- এসবই হতে পারে নদীকে রক্ষার শক্তিশালী উপায়। কারণ,  নৌনিরাপত্তা মানেই শুধু লঞ্চের নিরাপত্তা নয়, নদীরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
লালমনিরহাট থেকে

প্যানেল

×