ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৫ মে ২০২৫, ৩১ চৈত্র ১৪৩২

ধর্ম এখন স্রেফ পরিচয়ে পর্যবসিত— যার মাধ্যমে অন্যের ওপর আধিপত্য কায়েম হয়: ফরহাদ মজহার

প্রকাশিত: ২২:০৬, ১৪ মে ২০২৫; আপডেট: ২২:০৭, ১৪ মে ২০২৫

ধর্ম এখন স্রেফ পরিচয়ে পর্যবসিত— যার মাধ্যমে অন্যের ওপর আধিপত্য কায়েম হয়: ফরহাদ মজহার

ছবি: সংগৃহীত।

লেখক, চিন্তক ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহার আজ ১৪ মে, বুধবার তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে এক দীর্ঘ পোস্টে জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, এই অভ্যুত্থান কেবল একটি রাজনৈতিক উত্তাল ঘটনা নয়; বরং এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতিবাদী যুগের অবসান এবং নতুন একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি গঠনের সূচনা।

ফরহাদ মজহার লেখেন, "জনগণ এখানে ইতিহাসের কর্তা, বিশেষ কোন রাজনৈতিক বা মতাদর্শিক ধারা নয়।" তার মতে, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্র ও তরুণদের সংবেদনশীল অংশ এবং গুরুত্বপূর্ণ এক পর্যায়ে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী গুলি চালাতে অস্বীকার করে অভ্যুত্থানকে সফল করতে সহায়তা করে।

তার পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো,  “জুলাই গণঅভ্যুত্থান কেবল একটি রাজনৈতিক উত্তাল ঘটনা নয়; এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতিবাদী যুগের অবসান এবং রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি গঠনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এই অভ্যুত্থানের মর্মার্থ হলো—সেকুলার ও ধর্মীয় জাতিবাদের বাইনারি অতিক্রম করে জনগণকে একটি সম্মিলিত রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে সংহত করা। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মর্ম বুঝতে হলে আমাদের সবার আগে বুঝতে হবে কীভাবে জাতিবাদী ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট শক্তির পতনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে বাংলাদেশ নতুন ভাবে হাজির হচ্ছে এবং জনগণ নিজেরা নিজেদের গঠনের প্রক্রিয়া জোরদার করতে চাইছে।

১. বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির পতনের পর ধর্মবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির আবির্ভাব ছিল অনিবার্য। আওয়ামি দুঃশাসনকে জাস্টিফাই করার জন্য একে জামাত-শিবির ও উগ্রপন্থী ইসলামপন্থিদের হাতে জুলাই অভ্যুত্থানের বিজয় হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে বলে অনেকে দাবি করছেন। এই দাবি ভুল। এটা পরিষ্কার গণঅভ্যুত্থান সমাজে সক্রিয় ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারারা যৌথ অর্জন। এখানে কোন রাজনৈতিক দল নয়, কর্তা ছিল স্বয়ং জনগণ এবং তাদের নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্র-তরুণদের সংবেদনশীল অংশ। একটা পর্যায়ে মিছিলে গুলি চালাতে অস্বীকার করে গণভ্যুত্থানকে সফল করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন বাংলাদেশের সৈনিকেরা। জনগণ এখানে ইতিহাসের কর্তা, বিশেষ কোন রাজনৈতিক বা মতাদর্শিক ধারা নয়। বরং ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিরোধী যৌথ নেতৃত্বই আমরা দেখেছি, যাদের মধ্যে বিভিন্ন মত ও আদর্শ রয়েছে। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক ঐক্যের গিঁট বা বন্ধন হচ্ছে বাংলাদেশের মাটিতে কোন কিসিমের ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট শক্তির স্থান নাই এবং বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট সংবিধান বাতিল করে অবিলম্বে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ণের প্রক্রিয়া আমাদের শুরু করতে হবে।

‘জনগণ’ বলতে তাহলে বোঝায় যারা সেকুলার কিম্বা ধর্মীয় – সকল প্রকার ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা উৎখাত করে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন ও বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গঠন করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। সে লড়াইয়ে নিজেদের মধ্যে ঐক্য নির্মাণের জন্য আমাদের অজ্ঞতা ও অজ্ঞতপ্রসূত ভুলগুলো কোথায় সেটা তাহলে শনাক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

২. বিভিন্ন মতাদর্শিক ও সাংস্কৃতিক ধারা সমাজে থাকবে, তর্কবিতর্ক থাকবে, সেটা সমাজের শক্তি, দুর্বলতা নয়। কিন্তু যখন আমরা ‘মত’ বা কোন সিদ্ধান্তকে চিরায়ত ও শ্বাশ্বত গণ্য করতে শুরু করি, পর্যালোচনার ক্ষমতা হারাই -- তখন তা সজীব ও সক্রিয় চিন্তার প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে।

‘মত’ প্রকাশ করা আর ‘চিন্তা’ করতে পারা এক কথা নয়।

তাই আমর এখন বুঝতে পারি না ‘ধর্ম’ বলতে আমরা এখন যা বুঝি তা একান্তই গ্রিক-খ্রিস্টিয় পাশ্চাত্যে গড়ে ওঠা Religion ধারণার অনুকরণ মাত্র। তাই যখন একটি জনগোষ্ঠির রাজনৈতিক সত্তার সম্ভাব্য বিকাশ বোঝার জন্য ধর্মের পর্যালোচনার কথা ওঠে, আমরা ভাবি সেটা বুঝি ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, ধর্মের মধ্যে নিহিত সার্বজনীন আদর্শ ও নীতিনৈতিকতার স্বরূপ বিচার নয়। ফলে আমরা পিছিয়ে পড়ে যাই। ধর্মকে আমরা এখন স্রেফ পরিচয়ে পর্যবসিত করেছি যেন ভিন্ন পরিচয়ের মানুষের ওপর আমরা আধিপত্য কায়েম করতে পারি। এমনকি সম্ভব হলে তদের নির্মূলও করে দিতে পারি।

৩. তাই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রধান রাজনৈতিক মর্ম হচ্ছে সেকুলার হোক কিম্বা ধর্মীয় – সকল প্রকার জাতিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং জনগণকে সকল প্রকার ফ্যাসিবাদ, ফ্যসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ রাখা এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাত করে বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গঠনের কর্তব্যের প্রতি মনোযোগী করে তোলা।

সকল প্রকার পরিচয়বাদ ও জাতিবাদের কালপর্ব দ্রুত অতিক্রম করে যাওয়াই আমাদের এখনকার কাজ। যেন নিজেদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে গঠন করবার প্রক্রিয়া জোরদার করা যায়।”

নুসরাত

×