ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৫ মে ২০২৫, ৩১ চৈত্র ১৪৩২

চবির পঞ্চম সমাবর্তনে প্রধান উপদেষ্টা

আগামীর ভবিষ্যৎ ঠিক করবে ছাত্রসমাজ

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস

প্রকাশিত: ২২:১৭, ১৪ মে ২০২৫

আগামীর ভবিষ্যৎ ঠিক করবে ছাত্রসমাজ

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে বুধবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ম সমাবর্তনে সম্মানসূচক ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করা হয়

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ব্যবসাকেন্দ্রিক সভ্যতা আত্মঘাতী। আমাদেরকে নতুন সভ্যতা গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান অর্থনীতি ব্যবসার অর্থনীতি, মানুষের অর্থনীতি নয়। আমরা যে বিশ্ব গড়তে চাই সে ক্ষমতা আমাদের আছে। সব মানুষেরই আছে। অথচ আমরা গৎবাঁধা পথে চলতে চাই বলেই নতুন পৃথিবীর কথা চিন্তা করি না। আগামীর ভবিষ্যৎ ঠিক করবে ছাত্রসমাজ। তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে আমরা শুধু খন্ডিত বিষয়ে গবেষণার কাজে নিয়োজিত নই। পুরো বিশ্বকে মনের মতো করে সাজানোর জন্য আমাদেরকে নিয়োজিত করতে হবে। যদি সে লক্ষ্য আমাদের না থাকে তবে তা হবে গন্তব্যহীন গবেষণা।
বুধবার বিকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) পঞ্চম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ কথা বলেন। তিনি বলেন, পৃথিবীর ভবিষ্যৎ আমাদের প্রত্যেকের নিজেদের হাতে। আমরা যেভাবে বিশ্বকে গড়তে চাই সেভাবেই গড়তে পারি। তবে, আমি যেভাবে বলছি সেভাবে গড়তে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমি আমার কথা বলে যাচ্ছি, অন্যরা তাদের কথা বলবে। কিন্তু নিজেদের মনের একটি স্বপ্ন থাকতে হবে। আমরা কী ধরনের ভবিষ্যৎ চাই, কী ধরনের সংস্কার চাই, কী ধরনের সমাজ চাই, কী ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চাই এগুলো মনের মাধুরি মিশিয়ে নিজেদেরই বের করে নিতে হবে।
শান্তিতে নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, পাঁচ-দশ টাকা যে মানুষের জীবনে এত আনন্দ আনতে পারে আমার জানা ছিল না। তাদেরকে বলেছি, এই টাকা দিয়ে আপনি রোজগার করবেন আর আমার টাকা আমাকে ফেরত দেবেন, এতেই তারা খুশি।
প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তৃতায় বলেন, ১৯৭২ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। ’৭৪ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সারাদেশে চলছিল হাহাকার। সেই দুর্ভিক্ষ দেখে আমি মানুষের জন্য কিছু করার চিন্তা করি। সেই চিন্তা থেকে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা চালু করি। এটা নিয়ে যে নোবেল পুরস্কার পাব তা কখনো ভাবিনি। তবে, আমার নোবেল পুরস্কারের গোড়াপত্তন এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দুটি নোবেল পুরস্কারের জন্য গর্ব করতে পারে। একটি আমি নিজে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। আরেকটি পেয়েছি গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য। কারণ, গ্রামীণ ব্যাংকের জন্মও এই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
জনকণ্ঠের চবি সংবাদদাতা জানান, সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমি এখানে এসেছিলাম শিক্ষক হিসেবে, যতদিন গেল আমি দেখলাম আমি ছাত্র হয়ে গেছি। আমি আর শিক্ষকের ভূমিকায় নাই। ক্রমাগত শিখছি। বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জোবরা গ্রামের মহিলারাই আমার শিক্ষক হলেন। তাদের কাছে অনেককিছু শিখলাম। আমি অবাক হয়ে গেলাম। তাদেরকে পাঁচ-দশ টাকা ঋণ দিতে শুরু করলাম। পাঁচ-দশ টাকা যে মানুষের জীবনে এত আনন্দ আনতে পারে আমার জানা ছিল না। তাদেরকে বলেছি, এই টাকা দিয়ে আপনি রোজগার করবেন আমার টাকা আমাকে ফেরত দেবেন, এতেই তারা খুশি।
সমাবর্তন নিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন জীবনের একটি মস্তবড় ঘটনা। মানুষ সারাজীবন স্মরণ করে স্মৃতি সংরক্ষণ করে। নিজের পরবর্তী প্রজন্মকে দেখায়। দীর্ঘ সময় পরে এই সমাবর্তন হলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অভিনন্দন জানাই।
সমাবর্তন সভাপতিত্ব করেন চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন, শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বীর প্রতীক, বিদ্যুৎ ও খনিজ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নূর জাহান বেগম ও ইউজিসি চেয়ারম্যান ড. এস.এম.এ ফায়েজ।
সমাবর্তনে ২২ হাজার ৫৮৬ শিক্ষার্থীকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেওয়া হয়। এরমধ্যে ৪২ জন পিএইচডি ও ৩৩ জনকে এমফিল ডিগ্রিধারী রয়েছেন। মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে কলা ও মানববিদ্যা বিভাগের ৪ হাজার ৯৮৮ জন, বিজ্ঞানে ২ হাজার ৬৬৬ জন, ব্যবসায় প্রশাসনে ৪ হাজার ৫৫৩ জন, সমাজ বিজ্ঞানে ৪ হাজার ১৫৮, জীববিদ্যায় ১ হাজার ৬৮৫ জন, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ৭৯৬ জন, আইন ৭০৩ জন, শিক্ষা ৩১৭ জন, মেরিন সায়েন্স ২৮৪ জন, চিকিৎসা ২ হাজার ২৯৬ জন। সমাবর্তনের প্রাক্কলিত বাজেট প্রায় ১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আয় হয় ৬ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি খরচ প্যান্ডেল, সাজ-সজ্জা ও আবাসন ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে।
ড. ইউনূসকে চবির ডি-লিট ডিগ্রি প্রদান ॥ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ডি-লিট (ডক্টর অব লিটারেচার) ডিগ্রি প্রদান করেছে। পঞ্চম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তাকে এ ডিগ্রি প্রদান করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইয়াহইয়া আখতার।
দিনব্যাপী ব্যস্ত সময় পার ॥ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সকালে বিমানযোগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এসে পৌঁছান। বিমানবন্দরে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মুনিরুজ্জামানসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পদস্থ কর্মকর্তা এবং সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা তাকে অভ্যর্থনা জানান। বিমান বন্দর থেকে তিনি সরাসরি যান চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটিতে (নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল) যান। সেখানে তিনি বন্দরের উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। এরপর তিনি যান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে। সেখানে তিনি একগুচ্ছ উন্নয়ন পরিকল্পনার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন শেষে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে। সেখানে তিনি ডি. লিট ডিগ্রি গ্রহণ করেন এবং সমাবর্তন অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন।
কালুরঘাট নতুন সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ॥ চট্টগ্রামে কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর বহুল প্রত্যাশিত রেলসহ সড়ক সেতু নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বুধবার বেলা ১১টায় চট্টগ্রামের সার্কিট হাউস থেকে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ফলক উন্মোচন করেন তিনি।
উদ্বোধন ঘোষণা করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কালুরঘাট ব্রিজে আমার অনেক স্মৃতি। এই সেতুর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। আজ এখানে বোয়ালখালীর বাসিন্দারাও উপস্থিত আছেন। কালুরঘাট সেতু তাদের বহুল আকাক্সিক্ষত। এটি তৈরি হয়ে গেলে চট্টগ্রামবাসীর বহু কষ্টের অবসান হবে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানান, দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি কর্ণফুলী নদীর ওপর নতুন একটি কালুরঘাট সেতু নির্মাণ। এর নির্মাণকাজ শুরু হওয়ায় বোয়ালখালীসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসী উৎফুল্ল।
মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনবিষয়ক মতবিনিময় সভায় যোগদান ॥ বর্ষা মওসুম এলেই চট্টগ্রাম ভাসে পানিতে। নগরীর অধিকাংশ এলাকায় হাঁটু ও বুক সমান পানিতে তলিয়ে যায়। এ ভোগান্তি পিছু ছাড়ছে না নগরবাসীর।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গ্রহণের পর থেকে প্রধান উপদেষ্টা এ বিষয়ে সমস্যা নিরসনে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমবার চট্টগ্রামে এসেই সংস্থা ও প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে তিনি শহরের জলাবদ্ধতা চলতি বছরের বর্ষা মৌসুমে আগের তুলনায় অর্ধেকে এবং ক্রমান্বয়ে শূন্যে নামিয়ে আনতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস সম্মেলন কক্ষে মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনবিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা এ নির্দেশনা দেন।
চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের জন্য জমি বরাদ্দের দলিল হস্তান্তর ॥ চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের ২৩ একর জমির নিবন্ধিত দলিল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুস সালামের কাছে হস্তান্তর করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

প্যানেল

×