
দেশী হাঁসের চেয়ে উন্নত বাকৃবির পশু প্রজনন ও কৌলিবিজ্ঞান বিভাগের উদ্ভাবন বাউ ডাক হাঁস
সন্ধ্যা ঘনায়ে এলো বেলা গেল ঐ কোথা গেল হাঁসগুলো তই তই তই...
রওশন ইয়াজদানীর লেখা ‘তই তই তই’ নামের এই ছড়াটি এক সময় গ্রামবাংলায় খুব জনপ্রিয় ছিল। ওই সময় খালবিল নদী নালা থাকত পানিতে ভরা, গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে দেশী হাঁস লালন পালন করা হতো প্রচুর। কালের বিবর্তনে সেই দিনগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে।
তবে বর্তমান সময়ে বিভিন্ন প্রজাতির হাঁসের প্রজননে নতুন সম্ভাবনা জেগে উঠেছে। পাশাপাশি হাঁসের চাহিদাও বেড়েছে। বিশেষ করে শীতকালে হাঁসের ডিম সিদ্ধ আর হাঁসের মাংসের জুড়ি মেলা ভার। দেশী হাঁসের প্রজনন কমলেও দেশী হাসের আদলে এবার বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) উদ্ভাবন করেছে নতুন জাতের হাঁস। নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাউ-ডাক’।
ইতোমধ্যে এই হাঁস গ্রামবাংলার সমতল থেকে দেশের পাহাড়ি অঞ্চলেও লালন পালনের জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। যেখানে দেশী হাঁস বছরে ৭০ থেকে ৮০টি ডিম দেয়, সেখানে বাউ-ডাক জাতের হাঁস মাত্র ১০ থেকে ১২ সপ্তাহ বয়সে ২ থেকে ২.৫ কেজি ওজনের হয় এবং বছরে ২২০ থেকে ২৩০টি ডিম দেয়। দ্রুত বৃদ্ধির ক্ষমতা, কম মৃত্যুহার ও বাজারে ভালো দামের কারণে এটি দেশের প্রান্তিক খামারিদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে বাউ-ডাক হাঁস খামারিদের জন্য একটি নতুন আশার আলো হয়ে উঠছে। এটি দেশের কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম, বিশেষত প্রাণিজ প্রোটিনের চাহিদা পূরণে। খামারিদের জন্য এটি একটি লাভজনক ব্যবসা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে এবং ভবিষ্যতে এটি দেশের খামার ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠতে পারে।
উত্তরাঞ্চলের গ্রামে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল মাটিরাঙায় এই হাঁস লালন পালনে পরিবারগুলো স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। যেখানে আগে পাহাড়ে হাঁস লালন পালনের কথা চিন্তাই করা যেত না, সেখানে এই হাঁস ঘরে ঘরে লালন পালন করা হচ্ছে। সমতল থেকে পাহাড় সব স্থানের আবহাওয়ার সঙ্গে এই হাঁস মানিয়ে গেছে। এতে খামারিদের উপকৃত হচ্ছে।
বাউ-ডাক হাঁসটি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আবহাওয়ার
সঙ্গে খুব ভালোভাবে মানিয়ে নেয়। বিশেষ করে, এটি অল্পদিনে বেশি ওজন অর্জন করে এবং বেশি ডিম দেয়। এই হাঁসটির পালন খরচও অনেক কম, যার ফলে খামারি অধিক লাভ পেতে পারেন। বাউ-ডাক হাঁসের এই জাতটি উদ্ভাবন করেছেন বাকৃবির পশু প্রজনন ও কৌলিবিজ্ঞান বিভাগের গবেষকরা।
গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ড. সামছুল আলম ভূঁঞা জানান, দেশী ও বিদেশী হাঁসের সংকরায়নের মাধ্যমে বাউ-ডাক তৈরি করা হয়েছে। এটি দেশের আবহাওয়ায় লালন-পালনের জন্য উপযুক্ত এবং রোগবালাই তেমন হয় না। এটি ডুয়েল টাইপ মাংস ও ডিম উৎপাদনে উপযোগী জাত। ফলে এটি পালন করে খামারিরা দ্বিগুণ লাভবান হচ্ছেন। হাঁসের মাংসের জন্য এটি একটি সম্ভাবনাময় সংকরজাত যা প্রাণিজ প্রোটিনের চাহিদা লাঘবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তিনি জানান শুরুটা আমরা উত্তরাঞ্চলের উল্লাপাড়া ও পাহাড়ি অঞ্চল খাগড়াছড়ির মাটিরাঙার প্রান্তিক খামারিদের মধ্যে সরবরাহ করি। দেখা যায়, সেখানে ও তার আশপাশের এলাকায় দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে নতুন জাতের বাউ হাঁস। কম সময়ে দ্রুত বৃদ্ধি, মৃত্যুহার কম এবং মাংস ও ডিম উৎপাদনে অধিক লাভজনক হওয়ায় অনেকেই এই হাঁসের খামার গড়ার দিকে ঝুঁকছেন। বিশেষ করে উল্লাপাড়ার চয়ড়া গ্রামে ইতিমধ্যে ২০টিরও বেশি বাউ হাঁসের খামার গড়ে উঠেছে। পাহাড়ের মাটিরাঙায় পরিবারগুলো এই হাঁস লালন পালন করছেন।
উত্তরাঞ্চলের চয়রা গ্রামের খামারি ঝর্ণা খাতুন পল্লি কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ও মানবমুক্তি সংস্থার সহযোগিতায় প্রথম পর্যায়ে ৫০টি বাউ হাঁসের বাচ্চা নেয়। এ হাঁস পালন করে দুই মাসে গড় ওজন দুই কেজির বেশি হওয়ায় বিক্রি করে তিনি লাভবান হন। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে তিনি আরও ১০০টি বাউ হাঁসের বাচ্চা নিয়ে পালন শুরু করেছেন।
বাঙ্গালা গ্রামের আরেক খামারি শাহিনা খাতুন। তিনি ১০০টি হাঁস পালন করছেন এবং এখন পর্যন্ত একটি হাঁসও মারা যায়নি তার। তুলনামূলক কম খাবার খেয়ে দ্রুত বেড়ে ওঠা ও সুস্বাদু মাংসের কারণে বাজারে এর চাহিদা অনেক বেশি।
এমএমএসের প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো মারুফ হাসান বলেন, বাকৃবি উদ্ভাবিত নতুন জাতের হাঁস বাউ-ডাক। যেটি ১০-১২ সপ্তাহ বয়সে ২-২.৫ কেজি ওজন ও বছরে ২২০-২৩০টি ডিম দেয়। খামারের বায়োসিকিউরিটি, নিয়মিত টিকা প্রদানসহ কীভাবে হাঁসটি পালন করে লাভবান হওয়া যায়, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। কম সময়ে বেশি বৃদ্ধি ও মৃত্যুহার কম হওয়ায় হাঁসটি দিন দিন প্রান্তিক খামারিদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। যেটি অর্থায়ন করছেন পিকেএসএফ ও বাস্তবায়নে মানব মুক্তি সংস্থা।
এর আগে বাউ মুরগিও জনপ্রিয়তা লাভ করে দেশী মুরগির চাহিদা মেটাচ্ছে। তিনি সমতলের পাশাপাশি পাহাড়েও লালন পালনের বিষয়টি তুলে ধরেন। পাহাড়ি অঞ্চলে হাঁস পালন এতদিন ছিল সীমিত, কারণ এখানকার জলবায়ু ও ভূ-প্রকৃতি উপযোগী জাতের অভাব ছিল। তবে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউ) উদ্ভাবিত নতুন হাঁসের জাত বাউ-ডাক সেই সীমাবদ্ধতা ভেঙে গত বছর থেকে বেসরকারি সংস্থা আইডিএফের সহযোগিতায় মাটিরাঙ্গার জিয়ানগর এলাকায় খামার সৃষ্টি করেছে।
যা পাহাড়ে হাঁস পালনের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। একইসঙ্গে এ অঞ্চলে প্রবেশপথে বাউ হাঁস রাজ্য হিসেবে আখ্যা দিয়ে লিফলেট দেখা যায়, যা দর্শনার্থীদের বাড়তি আকর্ষণ ও কৌতূহল সৃষ্টি করে। সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পেলে এই হাঁসের জাত পাহাড়ি জনগণের জীবিকায় বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
সূত্র জানায় পাহাড়েখামারি উদ্যোক্তা রিনা বেগম ও জাকির হোসেন আইডিএফের সহযোগিতায় ৫০টি করে ১০০টি হাঁসের বাচ্চা দিয়ে নতুন করে খামার শুরু করে এখন এর সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছেন তারা। হাঁসগুলো বড় এবং দেখতে সুন্দর হয়। পাহাড়ে সিজনে প্রতিটা হাঁস ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা বিক্রি করছেন তারা। পুরুষ হাঁসের চাহিদা ও দাম বেশি হয়ে থাকে।
মাটিরাঙ্গা আইডিএফের প্রাণিস¤পদ কর্মকর্তা ডা. জাকিরুল ইসলাম বলেন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পিকেএসএফের অর্থায়নে এই প্রথম মাটিরাঙ্গা উপজেলার ১৩ জন খামারিকে বাউ-হাঁস খামার প্রদর্শনী দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে মাংস উৎপাদনের জন্য ১১ জনকে ৫০টি করে, ডিম উৎপাদনের জন্য ২ জনকে ২৪০টি বাউ হাঁসের বাচ্চা প্রদান করা হয়।
একই সঙ্গে হাঁসের ফিড, খাদ্যের পাত্র, পানির পাত্র, ওষুধসহ ঘর নির্মাণ খরচ আইডিএফ দিয়ে থাকে। যার তদারকি করছেন প্রাণিস¤পদ কর্মকর্তা ডা. সুমেন চাকমা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন বাউ-ডাক জাতটি সমতল ও পাহাড়ি অঞ্চলে আত্মকর্মসংস্থান ও পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।