
হ্যাঙ্গা দিয়ে মাছ ধরার উৎসবে মেতেছে গ্রামবাসী
শুরু হয়েছে বর্ষাকাল। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে খাল-বিল ও জলাশয় পানিতে পরিপূর্ণ। বর্ষার নতুন পানি পেয়ে মাছের ঝাঁকের বিচরণ শুরু হয়েছে। বৃষ্টির কারণে চারদিকে পানি থই থই করছে। খাল-বিল এবং বিভিন্ন জলাশয় পানিতে টইটম্বুর। সব জেলায় ‘হ্যাঙ্গা জাল’ দিয়ে মাছ ধরার ধুম পড়ে গেছে। আর এই সময়ে মাছ ধরার জন্য হ্যাঙ্গা জাল একটি জনপ্রিয় উপকরণ। বিশেষ করে গ্রামের আশপাশে খাল-বিলে মাছ ধরার জন্য এই জাল ব্যবহার করা হয়। চলছে আষাঢ় মাস। এ অঞ্চলের খাল-বিল ও জলাশয়গুলোতে গেলে দেখা মিলছে মাছ শিকারিদের এ উৎসব। হ্যাঙ্গা জালে সাধারণত ধরা পড়ে ট্যাংরা, টাকি, চান্দা, তারা চিকরা, পুঁটি, গুতুম, বাইম মাছসহ বিভিন্ন দেশীয় মাছ।
উত্তরাঞ্চলে এলাকা ভেদে কেউ বলেন ‘হ্যাঙ্গা জাল’ আবার কেউ বলেন ‘ঠেলা জাল’। ত্রিকোনা বিশিষ্ট এ জাল দিয়ে মাছ ধরার চিত্র গ্রামবাংলার একটি পুরানো ঐতিহ্য। বর্ষা এলে গ্রামে গ্রামে এ জালের প্রচল বেড়ে যায়। শিশু, তরুণ থেকে শুরু করে সব বয়সী পুরুষ মহিলা এ জাল দিয়ে মাঝ ধরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। অনেকে এই জাল দিয়ে মাছ ধরে নিজের জীবিকা নির্বাহ করেন।
কুড়িগ্রাম জেলায় রয়েছে ১৬টি নদ-নদী। রয়েছে ৫২টি ছড়া ও বিল। বর্ষাকালে এলেই নদ-নদীর তীরবর্তী এলাকাসহ জেলার প্রত্যেকটি গ্রামে গ্রামে এ জালের চাহিদা বেড়ে যায়। খাল-বিলগুলোতে এই জাল শিশু, তরুণ থেকে শুরু করে সব বয়সীর মানুষ মাছ ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চরম আনন্দে দল বেঁধে মাছ ধরে সকলে।
ধরলা ও বারোমাসিয়া (বাণিদাহ) নদীপাড়ের মানুষ, পাঁচগাছি বিল, দাসেরহাট বিল ভাঙ্গামোর বিল, সরলা বিল, লালমনিরহাট জেলার ইটপাতা গ্রামে আদিতমারির পলাশী গ্রামের খাল-
বিল আর জমিতে হ্যাঙ্গা জাল দিয়ে মাছ শিকার করে শৌখিন এই মাছ শিকারিরা।
ফুলবাড়ি উপজেলার নাওডাঙ্গা এলাকার কনক চন্দ্র রায় বলেন, ‘হ্যাঙ্গা জাল তিন ধরনের হয়ে থাকে। ছোট, মাঝারি ও বড়। ছাট হ্যাঙ্গা দিয়ে শিশুরা এমনকি নারীরাও মাছ শিকার করে। মাঝারি হ্যাঙ্গা দিয়ে তরুণরা মাছ ধরে আর বড় হ্যাঙ্গা দিয়ে স্বাভাবিক বয়সের মানুষ এবং পেশাজীবীরা মাছ ধরে থাকে। একটি হ্যাঙ্গা জাল তৈরি করতে সর্বনিম্ন তিনশ’ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়ে থাকে বলে জানান তিনি। আমরা বর্ষা মৌসুমে বাড়ির সামনে বিলে হ্যাঙ্গা ও চটকা জাল দিয়ে মাছ ধরে থাকি। প্রতিদিন শেষ বিকেলে ধানের জমিতে শিশু-কিশোরসহ কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ জন মানুষ এক সঙ্গে আনন্দের সঙ্গে মাছ ধরেছি। এখন আর আগের মতো দেশি মাছ নেই। তার পরও বেশ কিছু মাছ পাওয়া যায় বর্ষাকালে।
একই এলাকার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘হ্যাঙ্গা জাল দিয়ে মাছ ধরা গ্রাম বাংলার পুরানো একটি ঐতিহ্য। সাধারণত দেশি জাতের মাছ ধরা হয়ে এ জাল দিয়ে। বৃষ্টির পানিতে যখন গ্রামের খাল-বিল ও ডোবা-নালা ভরে যায়, তখন আমরা হ্যাঙ্গা দিয়ে মাছ ধরি। তবে এখন আর আগের মতো দেশি মাছ নেই। অনেক দেশি মাছ এখন বিলে পাওয়া যায় না। দেড় ঘণ্টা মাছ ধরে ৫শ’ গ্রাম পুঁটি, চ্যাংটি ও গদা মাছ পেয়েছি।
চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী নিলয় চন্দ্র রায় বললেন, ‘হ্যাঙ্গা জাল দিয়ে মাছ ধরার মজাই আলাদা। খুব ভালো লাগে, আমার আনন্দ লাগছে।
নাওডাঙ্গা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল হানিফ সরকার জানান, এখন দেশি প্রজাতির মাছের সংখ্যা কমে গেছে। একটা সময় আমি নিজেও বাড়ির পাশের বিলে ও ডোবায় গ্রাম বাংলার পুরানো ঐতিহ্য হ্যাঙ্গা দিয়ে মাছ ধরেছি। বর্ষাকালে বাড়ির আশপাশে চারদিকে পানি ওঠায় মাছের বিচরণ বেড়ে যায়। তখন পুরুষ-মহিলা-তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোর- সবাই মিলে মাছ ধরতে নেমে যায়। এর মজাই আলাদা। তার মতে অতিরিক্ত জমিতে কীটনাশক প্রয়োগের ফলে দিনে দিনে ছড়া বিল, ডোবায় দেশি মাছ কমে গেছে। এদিকে সরকারের অবশ্যই নজর দেওয়া দরকার।
প্যানেল