ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৭ জুন ২০২৫, ১৩ আষাঢ় ১৪৩২

রাজসিক সিংহদরজা, মার্বেলের মেঝে, জোড়া দিঘি

রাণীশংকৈলে রাজার বাড়ি

আব্দুল্লাহ আল নোমান, রাণীশংকৈল, ঠাকুরগাঁও

প্রকাশিত: ১৯:৪১, ২৭ জুন ২০২৫

রাণীশংকৈলে রাজার বাড়ি

রাণীশংকৈলে ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন রাজা টংকনাথের রাজবাড়ি

রাণীশংকৈল উপজেলা শহর থেকে ১.৩ কিমি পূর্বে বাচোর ইউনিয়নের কুলিক নদীর তীরে প্রায় ১০ একর জমির ওপর রাজা টংকনাথের রাজবাড়িটি অবস্থিত। উপজেলা সদর থেকে ১০ টাকা ভ্যান ভাড়ায় পৌঁছা যায় রাজা টংকনাথের রাজবাড়িতে। রাজবাড়ির নির্মাণশৈলী কারুকার্যময় বেশ সুন্দর। রাজবাড়ির মেঝে ছিল মার্বেল পাথরের তৈরি। একসময়ের জাঁকজমকপূর্ণ কারুকার্জে খচিত প্রাচীন এই রাজভবনটিতে এখনো অনেক কারুকাজ করা দেয়াল অবশিষ্ট আছে। রাজবাড়িটির ভিতরের পূর্ব পাশে একটি অন্ধরমহল রয়েছে। রাজবাড়ির পশ্চিমদিকে রয়েছে সিংহদরজা। অপরপ্রান্তে দুটি দীঘি রয়েছে। বিশাল এক সিংহ দরজা দিয়ে রাজবাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। রাজবাড়িসংলগ্ন উত্তর-পূর্ব কোণে রয়েছে কাছারিবাড়ি। লাল রঙের দালানটি স্থাপত্যশৈলীতে আধুনিকতার পাশাপাশি ভিক্টোরিয়ান অলঙ্করণের ছাপ সুস্পষ্ট। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে রাজবাড়িটি নির্মিত হয়। রাজা টংকনাথের পিতা বুদ্ধিনাথের আমলেই রাজবাড়ি নির্মাণ কাজ শুরু হয়। বুদ্ধিনাথের মৃত্যুর পরে রাজা টংকনাথ রাজবাড়ির অসমাপ্ত কাজ শেষ করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাজা টংকনাথের পূর্ব-পুরুষদের কেউ জমিদার ছিলেন না। বর্তমানে রাণীশংকৈল উপজেলা শহর হতে ৭ কিমি পূর্বে কাতিহার নামক জায়গায় গোয়ালা বংশীয় নিঃসন্তান এক জমিদার বাস করতেন। জমিদারের মন্দিরে সেবায়েত হিসেবে কাজ করতেন টংকনাথের পিতা বুদ্ধিনাথ। গোয়ালা জমিদার ভারত এর কাশি যাওয়ার সময় তাম্রপাতে দলিল করে যান যে, তিনি ফিরে না এলে মন্দিরের সেবায়েত বুদ্ধিনাথ জমিদারির মালিক হবেন। গোয়ালা জমিদার ফিরে না আসায় বুদ্ধিনাথ জমিদারির মালিক হন। তবে অনেকে মনে করেন এই ঘটনা বুদ্ধিনাথ দু-এক পুরুষ পূর্বেরও হতে পারে। রাজা টংকনাথ চৌধুরী খুব বড় মাপের জমিদার না হলেও তার আভিজাত্যের কমতি ছিল না। জমিদার বুদ্ধিনাথের দ্বিতীয় ছেলে টংকনাথ তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের আস্থা অর্জন করার জন্য মালদুয়ার স্টেট গঠন করেন। বিভিন্ন সময় সমাজসেবামূলক কাজের জন্য ১৯২৫ সালের ১৮ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্নর হাউসে টংকনাথ চৌধুরীকে ব্রিটিশ সরকার চৌধুরী উপাধিতে ভূষিত করেন। কথিত আছে, টংকনাথের আমন্ত্রণে তৎকালীন বড়লাট এবং দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজনাথ রায় রাণীশংকৈলে এলে আমন্ত্রিত অতিথিদের টাকার নোট পুড়িয়ে রীতিমতো রাজকীয় অভ্যর্থনা ও আপ্যায়ন করান এবং পর্যাপ্ত স্বর্ণালংকার উপহার দেন। এর ফলে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে চৌধুরী উপাধি এবং দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজনাথ রায়ের কাছ থেকে রাজা উপাধি পান। পরবর্তীতে দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজনাথ রায়ের বশ্যতা স্বীকার করে রাজা উপাধি পান। পরবর্তীতে রাজা টংকনাথের স্ত্রী রাণী শংকরী দেবীর নামানুসারে মালদুয়ার স্টেটের নামকরণ করা হয় রাণীশংকৈল। দেশভাগের প্রাক্কালে রাজা জমিদারি ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমান। এর মধ্য দিয়ে মালদুয়ার স্টেট রাজা টংকনাথ চৌধুরীর জমিদারি পরম্পরার সমাপ্তি ঘটে।  রাজবাড়ি থেকে প্রায় দুশ মিটার দক্ষিণে কুলিক নদীর তীরে রাস্তার পূর্বপ্রান্তে রয়েছে জয়কালী মন্দির। এই মন্দিরটি রাজবাড়ির চেয়েও প্রাচীন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকসেনারা মন্দিরটির ক্ষতি সাধন করে। বর্তমানে ওই এলাকার হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ইসকন মন্দির সংস্কার করে পূজা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রায় প্রতিদিনই অনেক আগ্রহভরে দৃষ্টিনন্দন এই রাজবাড়িটি দেখতে আসেন দূরদূরান্তের মানুষ। এছাড়াও প্রতি ঈদের ছুটিতে হাজার হাজার ভ্রমণপিপাসুরা আসেন রাজবাড়ীটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে। রাজবাড়িটি ২০১৯ সালে গেজেট হয়। ইতিহাস ঐতিহ্যের কারণে ৯ জানুয়ারি হানিফ সংকেতের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি রাজবাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। রাজবাড়ীটি দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত ও জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকায় রাণীশংকৈলের কৃতি সন্তান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মেহেদী হাসান শুভ হাইকোর্টে রিট করে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের নজরে আসে। ২০২৪ সালে রাজবাড়ি পরিদর্শনে আসেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাবিনা আলম। এ সময় তিনি রাজবাড়িটিকে সংস্কারের আশ্বাস দেন। পরবর্তীতে ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে সামান্যতম সংস্কার কাজ শুরু করলেও তা বন্ধ হয়ে যায়। রাজবাড়ীটি সংস্কার করা হলে এটি হতে পারে উপজেলার একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র এমন মন্তব্য দর্শনার্থীদের। যদিও কিছুদিন আগে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকে বাড়িটির কিছু সংস্কার করা হয়েছে তবে এটি চলমান রাখার দাবি এলাকাবাসীর। অনেকে মনে করেন এখানে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলে বাড়িটি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।

রাণীশংকৈল : হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী রামরায় দীঘি

রাজা শ্রী বীরেন্দ্রনাথের জগদল জমিদার বাড়ি
রাণীশংকৈল উপজেলা শহর থেকে ২৩ কি.মি দূরে কাশিপুর ইউনিয়নের বাংলাদেশ ভারত সীমান্তের সাথে জগদল নামক স্থানে রাজা শ্রী বীরেন্দ্রনাথের জগদল জমিদার বাড়ির অবস্থান। উপজেলা শহর থেকে ১৫ টাকা ভাড়ায় চার্জার ভ্যান ও অটো চার্জারে করে প্রথমে নেকমরদ চৌরাস্তায় নামতে হয় তারপর নেকমরদ চৌরাস্তা থেকে অটো চার্জার ও ভ্যান রিজার্ভ করে জগদল জমিদার বাড়িতে যাওয়া যায়। জগদল গ্রামে রয়েছে তীরনই ও নাগর নদীর মিলনস্থল যাকে মোহনা বলা হয়, যা বাংলাদেশের খুব কম জায়গায় রয়েছে। এছাড়া রয়েছে জমিদার বাড়ির পাশে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ক্যাম্প এবং প্রাচীনতম কালীমন্দির। এ জমিদার বাড়িটিতে পরিত্যক্ত অবস্থায় একাধিক স্থাপত্যিক কাঠামো দেখা যায়। লতাপাতা ও বৃক্ষরাজিতে ঘিরে থাকা এ জমিদার বাড়ির স্থাপনার মধ্যে বসতঘর, মন্দির, সীমানা প্রাচীরসহ প্রবেশ তোরণ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ইট, চুন, কাঠ ও লোহার বর্গা দিয়ে নির্মিত এ জমিদার বাড়ির স্থাপত্যিক কাঠামোসমূহে সমতল ছাদ, তুস্কান স্তম্ভ, অর্ধ-বৃত্তাকার খিলান এবং আস্তরের ব্যবহার লক্ষণীয়। জমিদার বাড়ির স্থাপনাসমূহ এখন প্রায় ধ্বংসের মুখোমুখি। জমিদার বাড়িটির সম্ভাব্য নির্মাণকাল উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ। বর্তমানে জমিদার বাড়িটি প্রায় ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। জমিদার বাড়ি খেকে প্রায় ১০০ মিটার পশ্চিমে নদীর পাড়ে মন্দির ছিল যা আজ সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই নেই। জগদলের রাজকুমার ছিলেন শ্রী বীরেন্দ্রনাথ । তাঁর সঙ্গে তৎকালীন ভারতের বাকীপুরের জমিদার রায় পূর্ণেন্দু নারায়ণ সিংহের পুত্র শ্রী নলিনি রঞ্জনের কনিষ্ঠা কন্যা শ্রী মতি আশালতা দেবীর বিয়ে হয়। শ্রী বিরেন্দ্র নাথ সুশিক্ষিত ছিলেন। বইয়ের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল অনুরাগ। এ কারণে তিনি গড়ে তুলেছিলেন সমৃদ্ধ পাঠাগার। ততকালীন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ-বর্তমান দিনাজপুর সরকারি কলেজে ১৯৪৮ সালে তার পাঠাগারের বইগুলো দান করা হয়। যার মূল্যমান ধরা হয় ৫০ হাজার টাকা। শোনা যায়, এই জমিদারবাড়িতে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ কাটিয়েছিলেন তার ছেলেবেলার কিছু সময়, যার স্মৃতি রক্ষার্থে এখানে ২০১৪ সালে তৈরি করা হয়েছিল হুমায়ূন মঞ্চ। বর্তমানে সেটি অরক্ষিত রয়েছে। জানা গেছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মেহেদী হাসান শুভর মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রিটের মাধ্যমে ২০২৪ সালে গেজেট হয়। গেজেট হলেও এখন পর্যন্ত সংস্কার কাজ শুরু হয়নি। জগদল জমিদার বাড়ি থেকে আধা কি.মি দক্ষিণে গড়ে তোলা হয়েছে নাগর নদী ভিউ পয়েন্ট। ভারত সীমান্তে সন্ধ্যার সময় সীমান্ত পিলারের লাইটিং আরও আকর্ষণীয় করে তোলে জায়গাটিকে। প্রতিদিন বিকেল হলে আশপাশের শত শত মানুষ ভিড় জমান এমন দৃশ্য দেখার জন্য। রাণীশংকৈল উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ চায় এই জমিদারবাড়িটি সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকার যেন সব ধরনের সহযোগিতা করে। সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া না হলে কালের সাক্ষী হিসেবে থাকা জমিদারবাড়িটি লোকচক্ষুর অগোচরে বিলীন হয়ে যাবে।

রাণীশংকৈল : রাজা শ্রী বীরেন্দ্রনাথের জগদল জমিদার বাড়ি

হাজার বছরের পুরনো দীঘি
জেলার রাণীশংকৈল উপজেলায় হোসেনগাঁও ইউনিয়নের উত্তরগাঁও গ্রামে উপজেলা সদর থেকে ৩ কি.মি দক্ষিণ-পশ্চিমে রামরায় দীঘি অবস্থিত। উপজেলা শহর থেকে চার্জার ভ্যানে করে ২০ টাকা ভাড়ায় রামরায় দীঘিতে যাওয়া যায়। প্রাচীন ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন রামরায় দীঘি বরেন্দ্র ভূমির প্রাচীন জলাশয়গুলোর মধ্যে আয়তনে দ্বিতীয় বৃহত্তম। পুকুরটি ১৮.৩৪ একর সুউচ্চ পাড় ও ২৩.৮২ একর জলভাগসহ মোট ৪২.২০ একর বিশিষ্ট। পুকুরটির দৈর্ঘ্য (উত্তর-দক্ষিণ) ৯০০ মিটার ও প্রস্থ (পূর্ব-পশ্চিম) ৪০০ মিটার। এর সঠিক ইতিহাস এখনো জানা যায়নি। ধারণা করা হয় দীঘিটি পাঁচশ থেকে হাজার বছরের পুরনো হতে পারে। একসময় এই দীঘি ছিল এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের পানির চাহিদা পূরণের উৎস। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য প্রাচীন নিদর্শন যা প্রচারণার অভাবে মানুষের নিকট পৌঁছায় না এমনি একটি ইতিহাসের নাম রামরায়। পুকুরটিকে কেন্দ্র করে ২০০৩ সালে রাণীসাগর ফাউন্ডেশন নামে একটি স্বেচ্ছসেবী প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। সেই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে পুকুরটির পাড়ে ১২০০ এর অধিক লিচু গাছসহ অন্যান্য ফলবান বৃক্ষ ও বিভিন্ন ভেষজ ও বনজ বৃক্ষের চারা রোপণ করা হয়েছে। প্রতি বছর লিচু গাছের ফল বিক্রয় করে ফাউন্ডেশন কর্তৃক বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নরত গরিব ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। চারদিকে সবুজের বিশাল সমারোহ ও দীঘির টলটলে জলরাশি দেখলে যে কোনো প্রকৃতিপ্রেমী মুগ্ধ না হয়ে পারে না। পাড়ের লিচু গাছে ও দীঘির পানিতে বিভিন্ন বর্ণালি পাখির কুজন রামরায়ের সৌন্দর্যকে আরও অধিক আকর্ষণীয় করে তুলে। রাণীশংকৈল রামরায় দীঘি ঠাকুরগাঁও জেলার সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহৎ দীঘিটি পাঁচশ থেকে হাজার বছরের পুরাতন হতে পারে। এর সঠিক ইতিহাস এখনো জানা যায়নি। 
বর্তমানে দীঘিটি একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এবং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য অনেকেই এখানে ভ্রমণ করেন। প্রতি বছর শীত মৌসুমে ডিসেম্বরের শেষের দিকে ও জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে উত্তর মেরু, ইউরোপ, সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, হিমালয়ের পাদদেশ, তিব্বত অঞ্চল থেকে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি আসে। সাদা বক, বালিয়া, পানকৌড়ি, ঘুঘু, সারস, রাতচোরা, গাংচিল, পাতিহাঁস, বুনোহাঁস, খঞ্জনা, ওয়ার্বলার, হাড়গিলা, স্নাইপ বা কাদাখাঁচা, কোকিল প্রভৃতি হাজার হাজার পাখির আগমনে দীঘির সৌন্দর্য বেড়ে যায়। উপজেলা প্রশাসন থেকে ইতোমধ্যেই রামরাই দীঘিকে নান্দনিক রূপ দিতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। দীঘির পাড়ে বসার জন্য চারটি ছাতার ছাউনি, পাঁচটি বসার মাচা, একটি নৌকা এবং একটি কাঠের সেতু তৈরি করা হয়েছে।

নেকমরদ পীর নাছির উদ্দিন শাহ্র (র.) মাজার শরীফ
রাণীশংকৈল উপজেলা শহর হতে প্রায় ১০ কিমি উত্তরে নেকমরদ চৌরাস্তা থেকে পূর্ব পাশে নেকমরদ পীর নাছির উদ্দীন শাহ্র (র.) মাজার শরীফের অবস্থান। রাণীশংকৈল হতে অটো চার্জার ও চার্জার ভ্যান যোগে নেকমরদ যাওয়া যায়। স্থানটির মূল নাম ছিল ভবানন্দপুর। তার পূর্বে এর নাম ছিল করবর্তন। নেকমরদের আরেকটি রহস্যময় দিক হলো পীর শাহ্ নেকমরদের মাজার। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন, ‘শেখ নাসির উদ্দিন (র.)’ নামে এক পুণ্যবান ব্যক্তি ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তৎকালীন ‘ভবানন্দপুর’ (বর্তমান নেকমরদ) নামক গ্রামে আসেন (সম্ভবত সুলতানি আমলে অর্থাৎ ১৪ শতকের কোনো একসময়)। তিনি ‘পীর শাহ্ নেকমরদ’ নামে পরিচিত হন, যার নামেই বর্তমান নেকমরদের নামকরণ। শোনা যায় ‘মুঘল সম্রাট খানকাহ’ নেকমরদ এর উন্নয়নের জন্য ৭০০ বিঘা জমি দান করেন। পীর শাহ্ নাসির উদ্দিনের জীবন নিয়ে রয়েছে নানা জনশ্রুতি। কেউ বলেন, তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, কেউ বলেন, তিনি ছিলেন এক মহান সাধক। আরব থেকে যে সূফি সাধক (৩ জন) উত্তর বাংলায় শান্তির বাণী প্রচারে এসেছিলেন তাদের মধ্যে ‘সৈয়দ নাসির উদ্দীন (র.)’ অন্যতম। কথিত আছে, তিনি যখন এ অঞ্চলে আসেন, তখন ‘ভীমরাজ’ ও ‘পীতরাজ’ নামে দুই অত্যাচারী রাজা এ জনপদ শাসন করতেন। পীর শাহ নেকমরদ তাঁদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং অলৌকিক শক্তিতে তাঁদের পরাজিত করেন। সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরীর ওপরই গড়ে ওঠে বর্তমান নেকমরদ। আবার অনেকে বলে, তিনি ভিমরাজের কাছে জায়গা চান বসবাসের জন্য। কিন্তু তিনি তাকে নদীর মধ্যে জায়গা দেখিয়ে দেন। পীর নদীর মাঝে গিয়ে জায়নামাজ পেতে নামাজ পড়েন আর তখন পানির ভেতর থেকে মাটি উঠে আসে আর তার ওপর তিনি ঘরবাড়ি তৈরি করেন। আবার অনেকে ভিন্ন মত পোষণ করে বলেন যে, এই পীরের আসল নাম ‘নাসির উদ্দিন পীর শাহ্’ তিনি যখন ভবানন্দপুর আসেন তখন এখানকার রাজা ছিল ভিমরাজ। সেই সময় এখানে একটি নদী ছিল। সেই নদী নেই কিন্তু বর্তমানে তার চিহ্ন আছে। বর্তমানে এখানে বড় খাল বা নালা আছে। পীর ভিমরাজার কাছে আশ্রয় চান কিন্তু তিনি আশ্রয় দেননি। রাজা নদীর মধ্যে জায়গা দেখিয়ে দেন। তখন পীর কলার পাতায় বসে রওনা হন মুনির দিকে। নদীর মধ্যখানে গিয়ে কলার পাতা আটকে যায়। তখন ঐখানে হঠাৎ করে বালুচর হয়ে যায়। পীর সিজদায় যান আর আশেপাশের সব রাজ প্রাসাদ ভেঙে পড়ে। কিছু পানির মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। যার ধ্বংসাবশেষ এখনো নালার মধ্যে পাওয়া যায়। তারপর থেকে পীর এখানে বসবাস শুরু করেন।

বেলে পাথরের অলৌকিক কূপ হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান

রাণীশংকৈলে অবস্থিত দেশের অন্যতম পুরাকীর্তি গোরক্ষনাথ মন্দির। উপজেলার নেকমরদ শহর থেকে ৭ কিমি। সেখান থেকে ৫ কিমি পশ্চিমে ‘গোরকই’ নামক গ্রামে এর অবস্থান। উপজেলা শহর থেকে প্রথমে ভ্যান বা চার্জার অটো যোগে নেকমরদ চৌরাস্তায় আসতে হয়, সেখান থেকে ভ্যান বা চার্জার অটো রিজার্ভ করে গোরকই মন্দিরে যেতে হয়। এ মন্দির ও মন্দিরের কূপটি অলৌকিকভাবে বেলে পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের। এখানে গোরক্ষনাথ মন্দির ছাড়াও আছে নাথ আশ্রম। গোরক্ষনাথ মন্দির স্থানীয়ভাবে গোরকই মন্দির নামেই পরিচিত। মন্দির চত্বরে আছে মোট ৫টি মন্দির। এছাড়াও আছে ৩টি শিবমন্দির ও ১টি কালি মন্দির। নাথ মন্দিরটি চত্বরের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত। নাথ মন্দিরের সাথেই উত্তরপাশে গোরকই কূপ। কূপটি সম্পূর্ণ বেলে পাথরে নির্মিত। বাংলাদেশের কোথাও পাথরের নির্মিত এধরনের কূপের সন্ধান পাওয়া যায় না। কূপটির চারদিকে ইটের প্রাচীর। তবে পূর্ব ও পশ্চিমদিকে একটি করে দরজা আছে। মূল ভূমি থেকে প্রায় তিন ফুট নিচুতে কূপের মেঝে। মেঝেটি বেলে পাথরে নির্মিত। মূল ভূমি থেকে মেঝেতে নামার জন্য সিঁড়িগুলোও বেলে পাথরের। কূপটির গভীরতা সাড়ে সাত ফুট এবং এর ব্যাস আড়াই ফুট। বেলে পাথর সামান্য বাঁকানোভাবে কেটে কূপের মুখ থেকে তলদেশ পর্যন্ত অত্যন্ত নিখুঁতভাবে বসানো হয়েছে। কূপের তলটুকুতেও মাটি নেই। একটি পাথরের সাথে আরেকটি পাথরের জোড়া লাগাতে কোনো মসলা ব্যবহার করা হয়নি। মনে করা হয় পাথরের জোড়াগুলো দিয়ে কূপটি পানিতে ভর্তি হতো। আবার এরূপ কথাও প্রচলিত রয়েছে যে কূপের তলদেশে পাথরের মাঝখানে দুটি ছিদ্র ছিল। সেই ছিদ্র দুটি বন্ধ করে দিলে কূপের ভিতরে পানি আসত না এবং খুলে দিলে পানিতে পূর্ণ হতো। পাপমোচন, সন্তান লাভসহ নানা মনবাসনা নিয়ে উত্তরাঞ্চলের লাখ লাখ হিন্দু নারী-পুরুষ এই কূপের পানিতে স্নান করার উদ্দেশে আসেন। এই কূপের পানিকে গঙ্গার মতোই পবিত্র মনে করেন হিন্দুধর্মাবলম্বীরা। এছাড়া শুদ্ধিকরণের জন্য শরীরে ছিটিয়ে দেওয়া হয় এই কূপের পানি। কূপটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এর পানি দিয়ে লাখ লাখ মানুষ স্নান করার পরেও কূপের পানি একটুও কমে না। পুরানো এই মন্দির ও বৈচিত্র্যময় আশ্চর্যকূপ ও এর পানি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে মহাপবিত্র এবং এটি তীর্থস্থান হিসেবে গড়ে উঠেছে। প্রতি বছর ফালগুনের শিব চতুর্দশীতিথীতে পাঁচ দিনব্যাপী ‘গোরক্ষনাথ বারণী’ নামে মেলার আয়োজন করা হয়। আর এই কূপে স্নান করতে ও শিব চতুর্দশীতিথীতে পূজা উপলক্ষে মেলায় বিভিন্ন জেলার নানা বয়সী লাখ লাখ নারী-পুরুষের সমাগম হয়। কূপের পূর্ব দিকে একটি দরজা এবং পশ্চিম দিকে একটি দরজা রয়েছে। এ দুটো দরজা দিয়ে স্নানের জন্য প্রবেশ করে পুণ্যার্থীরা। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সনাতন ধর্মের শত শত নারী পুরুষ মেলায় এসে মন্দিরে অবস্থিত (কথিত) অলৌকিক কূপে মানত করে পুণ্যস্নান করেন। মেলার সময় এ কূপের পানিতে স্নান করতে আসে দেশের বিভিন্ন জেলার হাজার হাজার ভক্ত। বিভিন্ন মানত করে পরিবার-পরিজনসহ তারা আসেন এই মন্দিরে। তবে অনেকের আশা পূরণ হলে মন্দিরে এসে পুনরায় পূজা এবং মানত করা, পাঠা ছাগল, হাঁস, মুরগিসহ নানা জিনিসপত্র দিয়ে যান। অতীতে মন্দিরটি প্রায় ২৭ একর জমি ওপর অবস্থিত ছিলো। বর্তমানে ৮-৯ একর জমি মন্দিরের দখলে আছে। বাকি জমিগুলো বেদখল হয়ে গেছে। এছাড়াও মন্দিরের দক্ষিণ পার্শ্বে দুজন পূজারীর সমাধি রয়েছে। গোরক্ষনাথের মৃত্যুর পর ওই দুজন পূজারী মন্দিরের দেখাশোনা করাকালীন তাদের মৃত্যুর পর মন্দিরের পার্শ্বেই তাদের সমাধিস্থ করা হয়। এ দুজন পূজারীর নামও সঠিক জানা নেই কারও। মন্দিরের উত্তরে আছে একটি পান্থশালা। পান্থশালার দরজায় একটি ফলক বা গ্রানাইট শিলালিপি ছিল যা বর্তমানে দিনাজপুর জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। এই শিলালিপিটি বাংলা অক্ষরে উৎকীর্ণ এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত শিলালিপিগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম। এছাড়াও এ মন্দিরে গ্রানাইট পাথরের বহুল ব্যবহার দেখা গেছে। এছাড়া মন্দিরের পাশেই অবস্থিত একটি বড় পুকুর রয়েছে, সেই পুকুরের চার পাশে পানিতে অনেক কালো রঙের পাথর ছিল, যার মধ্যে অনেকগুলোই হারিয়ে গেছে। মন্দিরটির সম্পর্কে আরও কথিত আছে, গোরক্ষনাথ ছিলেন নাথ পন্থীদের ধর্মীয় নেতা খীননাথের শিষ্য। নবম-দশম শতাব্দির মধ্যভাগে গোরক্ষনাথের আবির্ভাব ঘটে। তিনি ধর্ম প্রচারের উদ্দেশে এখানে মন্দির স্থাপন করেন। অলৌকিক ওই কূপটি সেই সময়ে নির্মিত বলে প্রবীণদের ধারণা। আবার অনেকের মতে, গোরক্ষনাথ কোনো ব্যক্তির নাম নয়, এটি একটি উপাধি মাত্র। গোরক্ষনাথ উপাধি চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য এই মন্দির ও আশ্রম নির্মাণ করা হয়। মন্দিরটি সরকারিভাবে রক্ষণাবেক্ষণের দাবি স্থানীয়দের।

মহেশপুর গ্রামে মহালবাড়ি মসজিদটি

মহালবাড়ি মসজিদ
রাণীশংকৈল উপজেলা সদর হতে উত্তরে মীরডাঙ্গী থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে মহেশপুর গ্রামে মহালবাড়ি মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদটিতে আসতে হলে প্রথমে উপজেলা সদর থেকে ১৫ টাকা ভাড়ায় মীরডাঙ্গী বাজার আসতে হবে । সেখান থেকে ভ্যান রিজার্ভ করে মসজিদটিতে যাওয়া যাবে। মসজিদে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায় ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান হোসেন শাহের আমলে এটি প্রতিষ্ঠিত। দিনাজপুর জাদুঘরে শিলালিপিটি সংরক্ষিত ছিল। শিলালিপি সূত্রে জানা যায় মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মিয়া মালিক ইবনে মজুমদার। 


এটি ছিল তিন গম্বুজ বিশিষ্ট। মসজিদে ভূমি থেকে প্রায় চার ফুট উঁচু চারদিকে শিলা প্রাচীর ছিল। যে শিলাগুলো থাম হিসেবে ব্যবহৃত সেগুলো নকশা করা। শিলা-প্রাচীরের উপরে নির্মিত হয় ইটের দেয়াল। ছাদেও শিলাখণ্ডের ব্যবহার ছিল। ছাদ থেকে পানি বের করে দেয়ার জন্য খোদিত শিলার ব্যবহার দেখা যায়। ১৯৭১ সালের পূর্বেই মূল মসজিদটি ধ্বংস হয় এবং সেখানে নির্মিত হয় নতুন মসজিদ। নবনির্মিত মসজিদটির ভিত ও মেঝেতে প্রাচীন মসজিদের পাথর এবং দেয়ালে ইট ব্যবহার করা হয়েছে। তবে মসজিদের কাছে নকশা করা ও নকশাবিহীন বেশকিছু শিলাখন্ড পড়ে রয়েছে। প্রাচীন মসজিদের নকশা করা প্রায় ৩৬ী৩০ ইঞ্চি আয়তনের শিলাখণ্ড নতুন মসজিদের মিহরাবে আটকানো আছে। এছাড়া প্রাচীন মসজিদের তিন তাকের নকশা করা শিলাখণ্ডের মিম্বারটি এখনো নতুন মসজিদের সামনে পড়ে রয়েছে। মসজিদের পূর্বপাশে আছে একটি ছোট দীঘি। দীঘিটির উত্তর পাড়ের ঘাট উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পাথরে বাঁধানো। মসজিদের দুশ মিটার পূর্বে জঙ্গলের মধ্যে দুটি কবর। কবর দুটি একসঙ্গে ইট দিয়ে বাঁধানো। কবরের উত্তর-পশ্চিমের কোণে নকশা করা একটি পাথরের থাম রয়েছে। হয়তো কবরের চারকোণেই এ ধরনের থাম ছিল। কবর দুটির মধ্যে একটি ‘বিশ্বাস পীরের’ মাজার বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিমত। সম্ভবত বিশ্বাস শব্দটি ক্রমান্বয়ে বিশওয়াশ থেকে বিশবাশ শব্দে বিকৃত হয়েছে। ফলে এলাকাটিকে বলা হয় বিশবাইশ মহাল। তবে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় লতাপাতায় ছেয়ে গেছে কবর দুটি কবরের উপরে একটি ডুমুর গাছ রয়েছে। এটি সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন বলে দাবী এলাকাবাসীর। বিঃদ্রঃ ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের রাত্রিযাপনের জন্য উপজেলা সদরে দেলোয়ার আবাসিক হোটেল, খন্দকার আবাসিক হোটেল, প্রবাসী আবাসিক হোটেল ও রাণীশংকৈল আবাসিক হোটেল রয়েছে। 

×