
.
দেশের ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড এখন নির্বাচনকেন্দ্রিক। নেতাকর্মীসহ সবাই ভোটের অপেক্ষা করছে। তাদের প্রত্যাশা এবারের নির্বাচন হবে জমজমাট। নিজ নিজ কৌশল নিয়ে নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচন কমিশনও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ নির্বাচনে অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দল অংশ নিতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিগত ৩টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের অধিকাংশ মানুষ ভোট দিতে পারেনি। আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চায় একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করে তাদের ইমেজ রক্ষা করতে। নির্বাচন কমিশনও চাচ্ছে একটি ভালো নির্বাচন উপহার দিয়ে দেশের মানুষের আস্থা ও প্রশংসা অর্জন করতে। আর ভোটাররাও চায় উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দ্রুত নির্বাচনের দাবি করতে থাকে। সেই সঙ্গে তারা নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিতে থাকে। তাদের এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমে বলা হয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের কথা। এক পর্যায়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এ বছর ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এই কথায় বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ক্ষুব্দ হয়। তারা নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দাবি করে। এরপর ঈদুল আজহার আগে জাতির উদ্দেশে ভাষণে ড. ইউনূস ২০২৬ সালের এপ্রিলে নির্বাচনের কথা বলেন। এতে আরও বেশি ক্ষুব্ধ হয় বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল। পরবর্তীতে গত ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর উভয় পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। এ ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলসহ জনমনে স্বস্তি ফিরে আসে।
এদিকে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে নির্বাচনের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনমুখী রাজনীতি জোরদার করতে থাকে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিসহ প্রায় অর্ধশত রাজনৈতিক দল নিজ নিজ কৌশলে কাজ করছে। তারা এখন মাঠে অধিকতর সক্রিয়। দেশে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু রাজধানী ঢাকা ছাড়াও সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করেছে রাজনৈতিক দলগুলো।
সূত্র জানায়, বিএনপি হাইকমান্ডের নির্দেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করতে দলের সিনিয়র নেতারা বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও মহানগর সফরে গিয়ে সভা-সমাবেশ করছেন। তাদের পাশাপাশি প্রতিটি সংসদীয় এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থীরাও গণসংযোগ জোরদার করেছেন। এছাড়া বিএনপি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়াও শুরু করে দিয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান জনকণ্ঠকে জানান, দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে নিতে কাজ করছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ সংসদীয় এলাকায় গিয়ে জনসংযোগ বৃদ্ধি করছেন। আমিও নরসিংদীতে আমার নির্বাচনী এলাকায় নিয়মিত যাচ্ছি। দলের নেতাকর্মীসহ এলাকার সর্বসাধারণের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছি এবং আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
সূত্র মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের পর দেশের নির্বাচনী মাঠ এখন বিএনপির অনুকূলে। তাই দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা চাচ্ছেন এই পরিবেশ থাকতে থাকতেই যেন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে যায়। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে বিএনপি বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারবে- এমন আশা থেকেই তারা দ্রুত নির্বাচন চান। আর ভোটের আগ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠ নিষ্কণ্টক রাখতে দলের সকল কেন্দ্রীয় নেতা এখন সারাদেশের বিভিন্ন মহানগর, জেলা ও উপজেলা চষে বেড়াচ্ছেন। তারা সভা-সমাবেশে নির্বাচনের পক্ষে বক্তব্য রাখার পাশাপাশি বিভিন্নভাবে জনসংযোগ কর্মসূচি জোরদার করছেন। এর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অধিকতর সক্রিয় করে সংসদ নির্বাচনের পথ সুগম করছেন।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আপাতত ৩০০ সংসদীয় আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বিএনপি হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে। নির্বাচনের আগে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা যেন দলীয় কর্মকান্ডে অধিকতর সক্রিয় হয় তারই অংশ হিসেবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রায়ই ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলার নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিটি সংসদীয় এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামীও সারাদেশে নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদারে কাজ করছে। দলের আমিরসহ সিনিয়র নেতারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশ করে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। জামায়াত ক্ষমতায় গেলে কিভাবে দেশের মানুষের জন্য অধিকতর কল্যাণকর কাজ করবেন সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করছেন।
কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীর তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় নিয়মিত সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। এ সময় তারা সাধারণ মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, অতীতে কোন দল ক্ষমতায় থাকতে দেশের জন্য কি করেছেন এবং জামায়াত রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলে কি কি করবেন। বিশেষ করে ঘুষ, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতিমুক্ত করে সমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার বিষয়টিকে তারা বেশি জোর দিচ্ছেন।
এদিকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সব রাজনৈতিক দলের আগে জামায়াতে ইসলামী ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর মাধ্যমে নির্বাচনের রাজনীতিতে চমক সৃষ্টি করেছে। দলের প্রার্থীরা এখন নিজ নিজ সংসদীয় এলাকায় চষে বেড়াচ্ছেন। পাড়া-মহল্লায় ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করছেন। সেই সঙ্গে লিফলেটে প্রার্থীদের পরিচিতি উল্লেখ করে তা সর্বসাধারণের কাছে বিতরণ করছেন।
ঢাকা-১৮ আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী অধ্যক্ষ আশরাফুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নিয়মিত এলাকাবাসীর সঙ্গে গণসংযোগ করছি। আমরা সুন্দর নগর ও সুন্দর মানুষ গড়ে তুলতে চাই। মাদক, জুয়া, সন্ত্রাস, কিশোর গ্যাং, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখলবাজি এবং ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়তে হবে। এ ছাড়াও এলাকাবাসীর উন্নয়ন ও সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আরও অনেক কাজ করতে হবে। এ জন্যই আমরা জনগণের কাছে এবারের নির্বাচনে জামায়াতকে ভোট দিয়ে উপরোক্ত কাজগুলো করার সুযোগ চাই।
জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করছে। সারাদেশের সর্বস্তরে কমিটি গঠনের পাশাপাশি নির্বাচনী প্রস্তুতিও সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছেন দলের নেতারা। দলের ক’জন কেন্দ্রীয় নেতা নিয়মিত নিজ নিজ সংসদীয় এলাকায় গিয়ে গণসংযোগও করছেন। শীঘ্রই অন্যান্য নেতাও নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় হবেন বলে জানা যায়। এবারের নির্বাচনে এনসিপি ৩০০ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বলেও জানা যায়।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ঢাকা-১১ আসনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নাহিদ ইসলামের একজন সমর্থক জনকণ্ঠকে জানান, এই সংসদীয় আসনের প্রতিটি এলাকায় নেতাকর্মীরা সক্রিয় রয়েছেন। এই এলাকায় নাহিদ ইসলামের বিপুল সংখ্যক কর্মী রয়েছেন। তারা যার যার অবস্থান থেকে কাজ করছেন। তবে এনসিপির সব নেতাকর্মী সংস্কার ও বিচার শেষ করে নির্বাচনের পক্ষে। তাই এখনো পুরোদমে নির্বাচনের মাঠে দলের নেতাকর্মীরা সক্রিয় নয়। বিচার ও সংস্কার শেষে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সবাই নির্বাচনের মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে তিনি জানান।
এ ছাড়াও গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি, জাসদ (জেএসডি) ১২ দলীয় জোট, সিপিবি, বাসদ, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, হেফাজতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, এলডিপি, এনডিএম, লেবার পার্টিসহ অন্যান্য দলও সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগসহ নিজ নিজ কৌশলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে নির্বাচন কমিশনও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে। অক্টোবরের মধ্যেই সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করার টার্গেট নিয়েছে ইসি। এর পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছ থেকে ইঙ্গিত পেলে নির্বাচনের তারিখসহ তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সিইসির বৈঠকে নির্বাচনের বিষয়ে আলাপ হয়েছে বলে জানা যায়। তবে কি আলোচনা হয়েছে তা এখনই প্রকাশ করতে নারাজ নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদ জনকণ্ঠকে জানান, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ করতে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন সবাই। যথাসময়ে এ প্রস্তুতি শেষ করা হবে। এ জন্য নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট সবাই কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
প্যানেল