
বিশ্ব অর্থনীতির মানচিত্রে বাংলাদেশের এক অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনেই জন্মেছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি শুধু এক নবীন জাতিকে নয়, গোটা পৃথিবীকে দেখিয়েছেন বিকল্প অর্থনীতির পথ। তিনি ড. মুহাম্মদ ইউনূস—নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, ক্ষুদ্রঋণ ধারণার জনক, এবং সামাজিক ব্যবসার প্রবক্তা। “একজন মানুষ, একটি স্বপ্ন, আর এক পৃথিবী বদলে দেওয়ার সাহস।” — এই কথাটিই যেন সবচেয়ে ভালোভাবে বর্ণনা করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে।
ড. ইউনূসের জন্ম ১৯৪০ সালের ২৮ জুন, চট্টগ্রাম শহরের বক্সিরহাটে। তার বাবা হাজী দুলা মিয়া একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী ছিলেন, মা সাফাত বেগম ছিলেন গৃহিণী। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। Vanderbilt University থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৭২ সালে দেশে ফিরে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দেন। ঠিক সেখান থেকেই শুরু হয় তার ব্যতিক্রমী ভাবনার যাত্রা।
১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ড. ইউনূসকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। তিনি দেখতে পান, মাত্র কয়েক ডলার পেলে গ্রামের অনেক দরিদ্র মানুষ নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারতেন। ব্যাংকগুলো দরিদ্র মানুষকে ঋণ দিতে রাজি নয়—এই ফাঁকটাই ভরাট করতে এগিয়ে আসেন তিনি। তিনি নিজ হাতে মাত্র ৮৫ ডলার ঋণ দেন ৪২ জন দরিদ্রকে, আর সেখান থেকেই জন্ম নেয় ক্ষুদ্রঋণের ধারণা।
১৯৮৩ সালে সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠা পান তার উদ্যোগ—গ্রামীণ ব্যাংক। এর মূল নীতিগুলো ছিল:
(১) জামানতবিহীন ঋণ
(২) দরিদ্র নারীদের অগ্রাধিকার
(৩) ক্ষুদ্র সঞ্চয়
(৪) আত্মনির্ভরতা ও ক্ষমতায়ন
২০০৬ সালে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করে। এ ছিল বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তি পর্যায়ে নোবেল পাওয়া এবং বিশ্বের দরবারে ক্ষুদ্রঋণের ধারণার গৌরবজনক স্বীকৃতি। এরপর তাকে দেওয়া হয়:
১. যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম
২. কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল
৩. র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার
৪. World Food Prize
৫. নিউজউইক, টাইম, ফোর্বস, ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ/অর্থনীতিবিদদের তালিকায় স্থান
ড. ইউনূস কেবল ক্ষুদ্রঋণেই থেমে থাকেননি। তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পান Social Business (সামাজিক ব্যবসা) ধারণার মাধ্যমে। এ ব্যবসার মূল কথা: ব্যবসা হবে সামাজিক সমস্যার সমাধান করতে, না যে উদ্দেশ্য কেবল মুনাফা অর্জন।
২০১০ সালের পর থেকে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধেও সমালোচনার ঝড় উঠে। মূলত তার ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলে কিছু মহল। সরকার ও গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের মধ্যে মতবিরোধ চরমে ওঠে। ২০১১ সালে ৭০ বছর পূর্ণ হওয়ার অজুহাতে তাকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
শুভ জন্মদিন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আজ এই মহান মানুষের জন্মদিনে আমাদের একটাই প্রার্থনা— আপনি সুস্থ থাকুন, দীর্ঘজীবী হোন। আপনার স্বপ্নে আমরা ভরসা খুঁজি।
রাজু