
ছবি: সংগৃহীত
১৯৭৫ সালের ২৫ জুন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। তখন মানুষের মৌলিক অধিকার বন্ধ হয়ে যায়, সংবাদপত্রে সেন্সর বসে এবং বিরোধী নেতাদের জেলে পাঠানো হয়। সেই সময় শুরু হয় এক ভয়ংকর কাজ— জোর করে পুরুষদের বন্ধ্যা করে দেওয়া। প্রায় ৮০ লক্ষ পুরুষকে অপারেশন করিয়ে বন্ধ্যা করা হয়, যার মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন মুসলিম।
হরিয়ানা রাজ্যের উত্তাওয়ার গ্রামের ঘটনা সেই সময়কার একটি দুঃখজনক উদাহরণ। দিল্লি থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরের এই মুসলিম প্রধান গ্রামটিতে এক রাতে হঠাৎ পুলিশ ঘিরে ফেলে। তারা গ্রামের সব সন্তান জন্মদানে সক্ষম পুরুষদের মাঠে জড়ো হতে বলে। অনেকেই ভয়ে পালিয়ে যায় জঙ্গলে, কেউ কেউ কূপে ঝাঁপ দেয়। কিন্তু মোহাম্মদ দিনু নামের একজন গ্রামেই থেকে যান। তিনি ও তার ১৪ জন বন্ধু পুলিশে ধরা পড়েন।
তাদের জোর করে গাড়িতে করে একটি বন্ধ্যাকরণ ক্যাম্পে নেওয়া হয়। সেখানে তাদের অপারেশন করা হয়। দিনু বলেন, “আমরা নিজেরা ধরা দিয়েছিলাম, যাতে পুরো গ্রামকে না ধরে নিয়ে যায়। আমাদের আত্মত্যাগে গ্রাম বেঁচে গেছে।”
এই বন্ধ্যাকরণ কর্মসূচি শুধু ভারতেরই পরিকল্পনা ছিল না, বিদেশ থেকেও চাপ ছিল। বিশ্বব্যাংক ভারতকে ৬৬ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেয় এই কর্মসূচির জন্য। যুক্তরাষ্ট্র খাদ্য সহায়তা দেওয়ার শর্তে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সফলতা দেখতে চায়।
সরকারি কর্মকর্তাদের বলা হয়েছিল, কতজনকে বন্ধ্যা করতে হবে। কেউ লক্ষ্য পূরণ না করলে তাদের বেতন বন্ধ করে দেওয়া হতো, কিংবা চাকরি চলে যেত। যারা রাজি হতো না, তাদের গ্রামে সেচের পানি বন্ধ করে দেওয়া হতো।
উত্তাওয়ার গ্রামেও এমনই হয়। পুলিশের আক্রমণে অনেক ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলা হয়, খাবারে বালু মেশানো হয়। চার দিন কেউ রান্না করতে পারেনি। এক কিশোর, মোহাম্মদ নূর, তখন তার বাবার কোলে ঘুমিয়ে ছিলেন। পুলিশ আসার পর তার বাবা পালিয়ে যান, নূর লুকিয়ে পড়ে। তাকে ধরা হলেও পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।
গ্রামের মুরুব্বি আবদুর রহমান সরকারের চাপে মাথা নত করেননি। তিনি স্পষ্ট বলেন, “আমি আমার এলাকার কুকুরও দেব না, আর তোমরা মানুষের কথা বলছো!” তবুও, গ্রাম রক্ষা করা যায়নি।
এই ঘটনার পরে উত্তাওয়ার গ্রামের অনেক ছেলের বিয়ে ভেঙে যায়, কেউ কেউ মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। অনেকে এই অপমানের বোঝা বইতে বইতে আগেই মারা যান।
আজ ভারতের জন্মহার কম, সরকার আর জোর করে কাউকে বন্ধ্যা করে না। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, আজকের ভারতেও জরুরি অবস্থার মতো ভয় আর চাপ আছে। প্রধানমন্ত্রী মোদীর আমলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কমেছে, সাংবাদিকদের জেলে যেতে হয়েছে, বিরোধীদের কণ্ঠ রোধ করা হয়েছে।
তবুও, জরুরি অবস্থার পরে ১৯৭৭ সালে মানুষ ভোটে ইন্দিরা গান্ধীকে হটিয়ে দেয়। সেটাই ভারতের গণতন্ত্রের শক্তি দেখিয়েছিল।
দিনু এখন নব্বইয়ের কাছাকাছি বয়সী। তার স্ত্রী সলিমা ২০২৪ সালে মারা গেছেন। দিনুর এক ছেলে, তিন নাতি আর বহু পুতিনাতি রয়েছে। তিনি গর্ব করে বলেন, “আমরা গ্রামকে বাঁচিয়েছি। না হলে ইন্দিরা গান্ধী এই গ্রাম পুড়িয়ে দিত।” তারপর তিনি হেসে বলেন, “আমি আমার দাদার সঙ্গে খেলেছি, এখন আমার পুতিনাতিদের সঙ্গে খেলি। সাত পুরুষ দেখেছি আমি! এমন সৌভাগ্য কজনের হয়?”
সূত্র: আল জাজিরা
এম.কে.