ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২

গাজায় নিরস্ত্র ত্রাণ প্রত্যাশীদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ ইসরায়েলি সেনাদের!

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ২৮ জুন ২০২৫; আপডেট: ০৭:০০, ২৮ জুন ২০২৫

গাজায় নিরস্ত্র ত্রাণ প্রত্যাশীদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ ইসরায়েলি সেনাদের!

ছ‌বি: সংগৃহীত

ইসরায়েলি পত্রিকা হারেৎজ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানিয়েছে, গাজায় ত্রাণ নেওয়ার জন্য জড়ো হওয়া নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্য করে ইসরায়েলি সেনাদের গুলি চালাতে “সরাসরি নির্দেশ” দেওয়া হয়েছিল তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে।

হারেৎজ জানায়, ইসরায়েল এই ঘটনাগুলোকে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ হিসেবে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। পত্রিকাটিতে কিছু সেনার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, তাদের বলা হয়েছিল যে, যারা কোনো ধরনের হুমকি তৈরি করছে না— তাদের প্রতিও প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহার করতে হবে।

গাজা সরকারের মিডিয়া অফিস বৃহস্পতিবার জানায়, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় গঠিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (GHF)-এর ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রগুলোর আশেপাশে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৪৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও ৪,০৬৬ জন।

একজন সেনা হারেৎজকে বলেন, “আমরা ট্যাংক থেকে মেশিনগান দিয়ে গুলি চালিয়েছি, গ্রেনেড ছুঁড়েছি। একবার কুয়াশার মধ্যে কিছু বেসামরিক মানুষ এগিয়ে এলে, তাদের গুলিতে হত্যা করা হয়।”

আরেকজন সেনা বলেন, “আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানে প্রতিদিন এক থেকে পাঁচজন মানুষ নিহত হতো। এটি যেন এক ‘হত্যার মাঠ’।”

জনসাধারণকে ‘নিয়ন্ত্রণের কৌশল’

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হারেৎজের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এক বিবৃতিতে সেনাবাহিনী বলে, “যদি আইন বা সামরিক নির্দেশ থেকে কোনো বিচ্যুতি হয়ে থাকে, তবে তা খতিয়ে দেখা হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে—যে বেসামরিকদের লক্ষ্য করে ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি চালানো হয়েছে—তা মাঠ পর্যায়ে পাওয়া যায়নি।”

প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ এই প্রতিবেদনকে “ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তচোষা অপবাদ” বলে অভিহিত করেছেন।

তারা বলেন, “আইডিএফ (ইসরায়েলি সেনাবাহিনী) কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে সন্ত্রাসী শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ছে, যারা বেসামরিক জনগণের আড়ালে থেকে হামলা চালায়। আইডিএফ নিরীহ বেসামরিকদের ক্ষতি এড়াতে স্পষ্ট নির্দেশনা মেনে চলে।”

হারেৎজ জানায়, সামরিক অ্যাডভোকেট জেনারেল সেনাবাহিনীর ‘ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং অ্যাসেসমেন্ট মেকানিজম’-কে নির্দেশ দিয়েছে aid distribution সাইটগুলোর ঘটনায় সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ খতিয়ে দেখতে।

প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক নির হাসন আল জাজিরাকে বলেন, এই গুলিবর্ষণ আদেশের পেছনে একটি “নিয়ন্ত্রণ কৌশল” রয়েছে। তিনি বলেন, “যখন আপনি চান, মানুষ যেন একটি জায়গা ছেড়ে চলে যায়—তখন আপনি গুলি ছুঁড়েন। এমনকি আপনি জানেন তারা নিরস্ত্র, তারপরও গুলি ছুঁড়ে মানুষকে সরিয়ে দেন।”

গাজা সরকারের মিডিয়া অফিস বলেছে, হারেৎজের প্রতিবেদনে প্রকাশিত সেনাদের স্বীকারোক্তি প্রমাণ করে GHF-এর নামে পরিচালিত এই কেন্দ্রগুলোতে “যুদ্ধাপরাধ” সংঘটিত হচ্ছে।

তারা বলেছে, “শান্তিপূর্ণভাবে খাবারের জন্য অপেক্ষমাণ জনতার ওপর ভারী মেশিনগান, আর্টিলারি ও শেল ব্যবহার করে নির্বিচারে গুলি চালানোর যে সামরিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা ইসরায়েলি বাহিনীর গণহত্যার প্রমাণ।”

আল জাজিরা-র আম্মান প্রতিনিধি হামদা সালহুত বলেন, এই ত্রাণকেন্দ্রগুলো এখন ফিলিস্তিনিদের জন্য “মৃত্যুকূপ” হয়ে উঠেছে।

তিনি বলেন, “মানুষ খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়াচ্ছে, কিন্তু তারা জানে এখানে আসা মানেই হয়তো মৃত্যু। অনেকের কাছে এখন দুইটি পথ— ক্ষুধায় মারা যাওয়া, অথবা গুলি খেয়ে মারা যাওয়া।”

GHF বর্তমানে গাজার কেন্দ্রে একটি ও দক্ষিণে তিনটি সাইট পরিচালনা করছে। মে মাসের শেষে ইসরায়েল অবরোধ আংশিক তুলে নেওয়ার পর সেখান থেকে ত্রাণ বিতরণ শুরু হয়। কিন্তু এর পর থেকেই এসব সাইটে ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলার সংখ্যা বেড়েছে।

শুক্রবার গাজার দক্ষিণাঞ্চলে ত্রাণ নিতে গিয়ে গুলিতে নিহত হন ছয়জন।

GHF এর ত্রাণ বিতরণ প্রক্রিয়ার “অমানবিকতা” নিয়ে ইতোমধ্যে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা সমালোচনা করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, “এই ধরনের প্রতিবেদনের দরকার নেই আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাপক লঙ্ঘন বোঝার জন্য। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘিত হলে জবাবদিহি প্রয়োজন।”

চিকিৎসাসেবামূলক সংগঠন ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (MSF) এই সাইটগুলোকে “মানবিক সাহায্যের মুখোশে গণহত্যার মঞ্চ” হিসেবে বর্ণনা করেছে।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৫৬,৩৩১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও ১,৩২,৬৩২ জন— এ তথ্য জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

সূত্র: আল জাজিরা

এম.কে.

×