
ছবি: প্রতীকী
আজকাল আমরা খুব সহজেই রেগে যাই। কেউ একটু ভিন্ন কিছু বললেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই সমস্যা আরও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কেউ যদি আমাদের পছন্দের দলের বিরুদ্ধে কিছু বলে, আমরা তাকে গালাগাল দিই। কেউ যদি ধর্ম, রাজনীতি বা সমাজ নিয়ে ভিন্ন মত দেয়, আমরা তাকে “মানুষ না”, “দেশদ্রোহী”, বা “মূর্খ” বলে দেই।
আমাদের সমাজে মতের অমিল কোনো নতুন ব্যাপার নয়। পরিবারে, বন্ধুর মধ্যে, সহকর্মীর সাথে— প্রতিদিনই আমরা ছোটখাটো অনেক বিষয়ে একমত হতে পারি না। কিন্তু আমরা সবাই জানি, এক বাড়ির ভাইরাও সব বিষয়ে একমত হয় না। তাহলে ফেসবুকে বা টেলিভিশনে কেউ অন্য রকম কিছু বললেই কেন সে আমাদের শত্রু হয়ে যায়?
আমরা এখন এমন একটা সময়ের মধ্যে আছি, যেখানে “তুমি আমার মতো না” মানেই “তুমি আমার বিরুদ্ধে”— এই মানসিকতা গভীরভাবে গেঁথে যাচ্ছে। এটা খুবই ভয়ংকর।
ভিন্নমত থাকা মানেই ভুল নয়। আপনি যদি লাল পছন্দ করেন আর আমি যদি নীল পছন্দ করি, তাহলে সেটা তো আমাদের ব্যক্তিগত পছন্দ। আপনি যদি কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করেন আর আমি আরেক দলকে করি, সেটা তো আমার নিজের মত। কিন্তু এখন যেন কাউকে ভিন্নমত পোষণ করতে দিলেই মনে হয়, সে আমার শত্রু। তাকে “শুদ্ধ করা” দরকার। তাকে “ধোলাই” দেওয়া দরকার।
আমরা কথা বলছি, কিন্তু শুনছি না। সবাই নিজের মত বলছে, কিন্তু কেউ আর শুনছে না অন্যের কথা। ফলে, মানুষ ক্রমেই একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ফেসবুকে ‘বন্ধু তালিকা’ বড় হলেও আসলে মানুষ একা হয়ে যাচ্ছে। কারণ, সবাই ভয় পাচ্ছে— ‘আমি যদি ভিন্ন কিছু বলি, লোকে কী বলবে?’
আমরা যেন ভুলে গেছি, ভিন্নমত থাকাই সভ্য সমাজের সৌন্দর্য। পৃথিবীর সব বড় আবিষ্কার, নতুন চিন্তা, সাহসী উদ্যোগ— সবকিছুর পেছনেই ছিল ভিন্নমত। কেউ যদি একসময় না বলত, ‘পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে’, তাহলে আজ আমরা আধুনিক বিজ্ঞান পেতাম না। কেউ যদি না বলত, ‘নারী-পুরুষের সমান অধিকার হওয়া উচিত’, তাহলে আমরা আজ নারীদের স্কুলে পড়তে দেখতাম না।
এটা অনেকটাই আসে আমাদের শিক্ষা ও পারিবারিক পরিবেশ থেকে। ছোটবেলা থেকেই আমরা শিখি— "বড়দের কথা মানতে হবে", "শিক্ষকের সঙ্গে তর্ক করা যাবে না", "সবসময় চুপচাপ থাকতে হয়"। এতে আমরা যুক্তি শিখি না, প্রশ্ন করতে ভয় পাই। আমরা শুধু শেখা কথাগুলো মুখস্থ করে বলি। কোনো নতুন কিছু শুনলেই ভয় পাই, কারণ সেটা আমাদের পরিচিত বিশ্বাসগুলোকে নাড়িয়ে দেয়।
এই ভয় থেকেই জন্ম নেয় ঘৃণা। আমরা যা বুঝতে পারি না, তাকে ভয় করি। আর যাকে ভয় করি, তাকে ঘৃণা করি। ধীরে ধীরে আমরা তার বিরুদ্ধে রেগে যাই। তাকে আক্রমণ করি।
কিন্তু আমরা যদি একটু সহনশীল হই, তাহলে দেখব— সব মানুষকে একভাবে ভাবতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। একজন মানুষকে চিনতে হলে শুধু তার একটিমাত্র মত দিয়ে বিচার করলে চলে না। তার জীবনের গল্প, অভিজ্ঞতা, পারিপার্শ্বিকতা— সবকিছু মিলেই সে যেমন হয়ে উঠেছে।
আমরা যদি কারো সঙ্গে একমত না-ও হই, তবুও তাকে সম্মান করতে পারি। শুনে দেখা যেতে পারে, তার কথার পেছনে কোনো যুক্তি আছে কি না। আর না থাকলে যুক্তি দিয়ে তার ভুলটা বোঝানো যেতে পারে। তর্ক নয়, আলোচনার মাধ্যমেই একটা সুন্দর সমাজ গড়ে ওঠে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই অজানা মানুষের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। একসময় সেটা গালাগাল বা খারাপ ভাষায় পৌঁছে যায়। অথচ চিন্তা করে দেখুন, আপনি যে মানুষটিকে আক্রমণ করছেন, তিনি তো আপনার মা, বাবা, ভাই বা বোনের বয়সীও হতে পারেন। আপনি যেভাবে সম্মান চান, তিনিও নিশ্চয়ই সম্মান পাওয়ার যোগ্য।
ভিন্নমত থাকলেও একে অপরের প্রতি সম্মানবোধ থাকা জরুরি। সেটা না থাকলে সমাজে বিশৃঙ্খলা বাড়বে। আমরা একে অপরের মুখ দেখতে চাইব না। কেউ কোনো কিছু বলার সাহস পাবে না। একটা সমাজে যদি ভয় আর ঘৃণাই রাজত্ব করে, তাহলে সেখানে ভালোবাসা থাকবে কোথায়?
আমাদের উচিত, নতুন প্রজন্মকে যুক্তি শেখানো। তাদের প্রশ্ন করতে শেখানো। আমরা যদি সন্তানদের শেখাই— "তোমার মত অন্যের সাথে মিলবে না, সেটা স্বাভাবিক", তাহলে তারা বড় হয়ে আরও সহনশীল মানুষ হবে।
আমাদের স্কুল-কলেজগুলোতে “মত প্রকাশের স্বাধীনতা” নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। শিক্ষকেরা যদি ছাত্রছাত্রীদের মুক্তভাবে ভাবতে দেন, তাহলে তারা জীবনের নানা বিষয়ে নিজের মতো করে চিন্তা করতে শিখবে। তখন সমাজেও একে অপরকে সম্মান করার মনোভাব গড়ে উঠবে।
ভিন্নমতকে ভয় নয়, গ্রহণ করতে শিখতে হবে। সেটা আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কেও কাজে লাগবে। একজন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, বন্ধুদের মধ্যে, এমনকি বাবা-মেয়ের মধ্যেও ভিন্নমত থাকতে পারে। কিন্তু সেটা মানে এই না যে তারা একে অপরকে ভালোবাসে না। তারা ভিন্নভাবে চিন্তা করে— তাতে তো সম্পর্ক আরও সমৃদ্ধ হয়।
আমরা যদি সমাজকে সুন্দর করতে চাই, তাহলে সবচেয়ে আগে আমাদের মনকে বড় করতে হবে। ভিন্নমত শুনে রাগ নয়, বরং কৌতূহল জাগানো উচিত— “আচ্ছা, এই মানুষটা কেন এমনভাবে ভাবছে?” এমন প্রশ্ন করলে আমরা একে অপরকে বুঝতে শিখব।
শেষ কথা হলো, মতের ভিন্নতা থাকবেই। সেটাই মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আমরা যদি সেই ভিন্নতাকে ঘৃণা না করে শ্রদ্ধা করতে শিখি, তাহলে সমাজে শান্তি থাকবে। থাকবে মানবিকতা, সৌহার্দ্য আর একে অপরকে বোঝার আন্তরিক চেষ্টাও।
ভিন্নমত হোক আলোচনার পথ, শত্রুতার নয়। তাহলেই আমরা এক মানবিক সমাজ গড়তে পারব।
লেখক: সাংবাদিক
এম.কে.