
গতকাল থেকে যে মানুষটি আমাকে গভীর উৎকণ্ঠায় রেখেছে, সে এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্রে ব্যস্ত। এই পরীক্ষাটি ২০.০৬.২০২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, আর সে ঠিক এই দিনটিতে পরীক্ষা দেওয়ার জন্যই দুই দিন আগে গ্রাম থেকে আমার বাসায় এসেছিল।
গতকাল সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে আমাকে জানালো যে তার পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে গেছে এবং পরবর্তীতে নতুন তারিখ জানিয়ে দেওয়া হবে। সারাদিন শেষে রাতে যখন আমরা খাচ্ছিলাম, তখন সে আবার বললো, "শনিবার যদি পরীক্ষা হয়, তাহলে রাতেই মেসেজ পেয়ে যাবো।"
আমার মনে খটকা লাগলো। আমি বললাম, "তুমি তো বললে অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়েছে। তাহলে শনিবারেই পরীক্ষা হবে ভাবছো কেন?" আমি তাকে পরীক্ষা পেছানোর মেসেজটা দেখাতে বললাম। মেসেজটি ছিল এমন:
"NDR Preliminary Exam date- 20/06/2025: Candidate will not be allowed to enter the exam hall after commencement of the exam. Nobody will be allowed to carry any mobile phone or electronic devices in the exam hall."
এই মেসেজের কোথাও কি পরীক্ষা স্থগিত হওয়ার কোনো কথা আছে? অথচ দূর গ্রাম থেকে কষ্ট করে আসা আমার পরীক্ষার্থী এমনিতেই এটা আবিষ্কার করে ফেললো। অন্ধকার কত স্পষ্ট, কত স্বচ্ছ!
আমার মনে পড়ে গেল কয়েক বছর আগের কথা, যখন কোভিড মহামারিতে পৃথিবী স্থবির। আমার পাশের গ্রাম থেকে একজন কলেজ শিক্ষক তাঁর অসুস্থ বাবাকে নিয়ে এলেন। সন্ধ্যার পর তাঁরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছে আমাকে ফোন করলেন। আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে কর্মরত। আমি জরুরি বিভাগে চিকিৎসকের সাথে কথা বললাম। কথা না বললেও সমস্যা হতো না, কারণ যথাযথ নিয়মেই রোগী ভর্তি হলেন। পরদিন কোভিড টেস্ট করা হলো এবং রেজাল্ট নেগেটিভ এলো। কিন্তু তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল কোভিড ওয়ার্ডে। তিনি কোনোভাবেই তাঁর বাবাকে কোভিড ওয়ার্ডে রাখবেন না, এবং নিজেও থাকবেন না। অগত্যা তাঁরা ঢাকা মেডিকেল থেকে চলে গিয়ে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করলেন। আমিও সহযোগিতা করলাম।
দু'দিন তাঁদের কোনো খবর নেই। পরদিন তিনি আমাকে ফোন করলেন, বললেন তাঁর বাবাকে নিয়ে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কোভিড টেস্ট করাচ্ছেন। সেখানেও চিকিৎসক রোগীকে কোভিড ওয়ার্ডে ভর্তি করেছেন। আমার কেমন সংশয় হলো। তাঁর বাবার চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ছবি তুলে পাঠাতে বললাম।
আমি দেখলাম, প্রথম থেকেই চিকিৎসকরা মনে করেছেন এটি ক্লিনিক্যালি কোভিড, অনেক সময় ফলস নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। তাঁদের অভিজ্ঞতায় এটি কোভিড। আমি তাঁকে বললাম, এই লেখাগুলো তিনি পড়েছেন কিনা বা চিকিৎসকেরা এমন বলেছেন কি না। তাঁর কোনো পরিষ্কার উত্তর পাইনি। একজন কলেজ শিক্ষক তাঁর শিক্ষা ও জ্ঞান নিয়ে তাঁর বাবার চিকিৎসা করিয়ে বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন। তবে তাঁর বাবা অনেকটা সুস্থ হয়ে ফিরে যান, এটা আনন্দের।
পরের কাহিনি আমার পাশের বাড়ির ভ্রাতুষ্পুত্রের। এমএ পাশ, কিন্তু সরকারি চাকরি হয় না। আমার ভাগ্নে তাকে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির ব্যবস্থা করে দিল। যথাসময়ে সে যোগদান করলো। দুয়েক দিন পর অন্য এক সহকর্মী নামাজে যাওয়ার সময় তাকে একটি পাতা টাইপ করে রাখতে বললেন, তিনি এসে দেখবেন। আমার গুণবান ভ্রাতুষ্পুত্র, যে গ্রামের জ্ঞানবান, জ্ঞানাম্বুধি, জ্ঞান চূড়ামণি—সে এই কাজটি করতে সমর্থ হয়নি। অতঃপর কাউকে কিছু না বলে নিজের গৃহে, নিজের সাম্রাজ্যে ফিরে এসেছে।
যেখানে আমি জন্মেছিলাম, যেখানে বড় হয়েছি, লেখাপড়াও শিখেছি—চারিদিক ছিল আলোকিত শিক্ষায়, সৌহার্দ্যে, গানে। এখন কেমন অন্ধকার! বড় স্পষ্ট আলোকিত অন্ধকার। আর আমি সেই অন্ধকারেরই বাসিন্দা।
Mily