
ইসরায়েলি হামলায় নিহত ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা, পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও কিছু বেসামরিক নাগরিকের স্মরণে তেহরানে অনুষ্ঠিত হলো রাষ্ট্রীয় জানাজা। শনিবার সকালে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে রাজধানীর রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ কালো পোশাকে, জাতীয় পতাকা ও শহীদদের ছবি হাতে নিয়ে অংশ নেন।
স্থানীয় সময় সকাল ৮টায় (গ্রিনিচ মান সময় ৪টা ৩০ মিনিট) শুরু হওয়া এ জানাজার দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার করে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন। তেহরানের কেন্দ্রস্থলে জাতীয় পতাকায় মোড়ানো কফিনে শহীদ সামরিক কর্মকর্তাদের ছবি পরিয়ে প্রদর্শিত হয়। আজাদি স্ট্রিটজুড়ে কফিনবাহী ট্রাক এগিয়ে যেতে থাকলে জনতা স্লোগান দেয়: “আমেরিকার মৃত্যু হোক”, “ইসরায়েলের মৃত্যু হোক।”
গত ১৩ জুন ইসরায়েল তাদের আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ ইরানে ব্যাপক হামলা চালায়। এতে ইরানের বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হন। দেশটির সামরিক ঘাঁটি ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকেও লক্ষ্য করে বোমাবর্ষণ করা হয়। এর পাল্টা জবাবে ইরান ইসরায়েলের ওপর ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।
১২ দিন ধরে চলা এই যুদ্ধের একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রও এতে জড়ায় এবং গত সপ্তাহে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরান কাতারে অবস্থিত একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে একযোগে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।
মঙ্গলবার যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও ইসরায়েল ও ইরান উভয়পক্ষই নিজ নিজ বিজয়ের দাবি করে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনেয়ি যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে বলেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘটনাগুলোকে “অস্বাভাবিকভাবে অতিরঞ্জিত করেছেন।” তিনি দাবি করেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি কয়েক দশক পিছিয়ে পড়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্র যে দাবি করছে, তা ভিত্তিহীন।
যুদ্ধের প্রথম দিনেই নিহত হন ইসলামী বিপ্লবী গার্ডের প্রধান জেনারেল হোসেইন সালামি এবং গার্ডের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির প্রধান জেনারেল আমির আলি হাজিজাদে। তারা উভয়েই ইসরায়েলের টার্গেট ছিলেন, যার উদ্দেশ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস করা।
এছাড়া, বিপ্লবী গার্ডের আরেক শীর্ষ কর্মকর্তা মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি এবং শীর্ষ পারমাণবিক বিজ্ঞানী মোহাম্মদ মাহদি তেহরানচিও ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন।
যুদ্ধবিরতির পর এই প্রথম প্রকাশ্যে এমন জানাজার আয়োজন করা হলো। রাষ্ট্রীয় টিভির খবরে বলা হয়, শনিবারের জানাজা ছিল মোট ৬০ জন শহীদের জন্য, যাদের মধ্যে চারজন নারী ও চারজন শিশু রয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে দিনের জন্য দপ্তরসমূহ বন্ধ রাখা হয়।
শব্দযুদ্ধ ও ট্রাম্পের হুমকি
জানাজার ঠিক আগের দিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশালে এক ভিডিও বার্তায় খামেনেয়িকে আক্রমণ করে বলেন, “আমি জানি সে (খামেনেয়ি) কোথায় আশ্রয় নিয়েছিল, কিন্তু আমি ইসরায়েল বা মার্কিন সেনাদের দিয়ে তাকে হত্যা করিনি।” তিনি আরও দাবি করেন, ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয়ে কাজ করছিলেন, কিন্তু খামেনেয়ির বক্তব্যের পর তা বাদ দেন।
এর জবাবে শনিবার ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি এক্স-এ বলেন, “ট্রাম্প যদি সত্যিই সমঝোতা চান, তাহলে খামেনেয়িকে উদ্দেশ করে এমন অবমাননাকর ও অগ্রহণযোগ্য ভাষা পরিহার করা উচিত।”
তেহরান থেকে আল-জাজিরার প্রতিনিধি রেসুল সেরদার জানান, ট্রাম্পের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আরাগচির বক্তব্য ছিল অত্যন্ত প্রত্যাশিত। তিনি বলেন, “ইরানে খামেনেয়িকে শুধু ধর্মীয় নেতা হিসেবেই নয়, সংবিধান অনুযায়ী তিনি রাষ্ট্রপ্রধান, সামরিক প্রধান এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের সর্বোচ্চ আসনে রয়েছেন। শিয়া ধর্মতত্ত্ব অনুযায়ী, খামেনেয়ির অবস্থান কেবল রাজনৈতিক নয়, তা এক ধরনের ঈশ্বরিক নেতৃত্বও বহন করে।”
তিনি আরও বলেন, “বিশ্বজুড়ে বহু শিয়া খামেনেয়ির দিকনির্দেশনার অপেক্ষায় থাকেন। ফলে যেকোনো সচেতন ব্যক্তি কখনোই প্রকাশ্যে তাকে মিথ্যাবাদী বলবে না।”
পারমাণবিক আলোচনা নিয়ে অনিশ্চয়তা
রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারে খামেনেয়িকে জানাজার অনুষ্ঠানে দেখা না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে, তিনি পূর্বের মতোই পর্দার আড়ালে শহীদদের কফিনে প্রার্থনা করেছেন, যা পরে টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হবে।
১২ দিন ধরে চলা যুদ্ধের সময় ইসরায়েল দাবি করে, তারা প্রায় ৩০ জন ইরানি কমান্ডার ও ১১ জন পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে। একইসঙ্গে আটটি পারমাণবিক স্থাপনাসহ ৭২০টি সামরিক অবকাঠামোতে হামলা চালানো হয়েছে। এদিকে ইরান থেকে ইসরায়েলের দিকে ৫৫০টিরও বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। এর অনেকগুলো ভূপাতিত করা গেলেও কিছু ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে, যাতে ২৮ জন নিহত হন বলে ইসরায়েল দাবি করে।
তবে তেহরান জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় তাদের অন্তত ৬২৭ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে।
যুদ্ধের শেষদিকে ট্রাম্প বলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে নতুন আলোচনার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তেহরান তা প্রত্যাখ্যান করে জানায়, আপাতত কোনো আলোচনা শুরু হওয়ার পরিকল্পনা নেই।
ইসরায়েল-ইরান সংঘর্ষে মৃত্যু, প্রতিশোধ, কূটনৈতিক লড়াই ও ধর্মীয় আবেগ সব মিলিয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিশ্ব রাজনীতির দৃষ্টিও এখন স্থির হয়ে আছে তেহরান ও তেলআবিবের দিকে। যুদ্ধ থামলেও সংঘাতের ছায়া এখনো গভীর।
সূত্র:আল-জাজিরা
আফরোজা